‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ বা ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’— সংবাদপত্র খুললে হামেশাই চোখে পড়ে এই শব্দবন্ধটি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী, তা সকলেরই জানা। এমনকি জলবায়ু যে ক্রমশ বদলাচ্ছে, উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বিশ্ববাসীও। এবার এসবের মধ্যেই ফের চিন্তার ভাঁজ পড়ল গবেষকদের কপালে। শুধু ভূপৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলই নয়, অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সমুদ্র এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও। যা পৃথিবীকে ঠেলে দিতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে।
‘ওসান ওয়ার্মিং’ (Ocean Warming)। অস্বাভাবিকহারে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনাকে এই বিশেষ নামেই চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা। আসলে সূর্যের তাপে বায়ুমণ্ডল এবং ভূপৃষ্ঠ সহজে উত্তপ্ত হলেও, সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে সময় লাগে অনেক বেশি। কারণ লিনতাপ নির্গমনের মাধ্যমে সমুদ্রের জলের একটা বড়ো অংশ পরিণত হয় জলীয় বাষ্পে। নিয়ন্ত্রিত হয় জলরাশির তাপমাত্রা। অথচ, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতির এই স্বাভাবিক সমীকরণকে উপেক্ষা করেই বেড়ে চলেছে সমুদ্রের উষ্ণতা।
গবেষণা অনুযায়ী, বিগত ১৫ বছর ৫০ শতাংশ উত্তপ্ত হয়েছে পৃথিবী। আমরা মূলত ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাবৃদ্ধি নিয়ে মেতে থাকলেও, এই ঘটনার পিছনে দায়ী আদতে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। গবেষকরা জানাচ্ছেন, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে এই সময়ে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার মধ্যে কেবলমাত্র বিগত ৪০ বছরেই ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে সমুদ্রের উষ্ণতা। ফলে তুলনামূলকভাবে সমুদ্র কম উত্তপ্ত হয়েছে মনে হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সমুদ্রের তাপমাত্রা।
গবেষকদের অনুমান, পরের মাসেই বিশ্বের একাধিক জায়গায় দেখা যেতে পারে এল নিনোর প্রভাব। তীব্র তাপপ্রবাহে টিকে থাকা দায় হয়ে উঠতে পারে উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে আগামীতে বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও। বদলাবে আন্তর্জাতিক বৃষ্টিরেখা। ফলে সার্বিকভাবে মানব সভ্যতার সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে চলেছে এই পরিস্থিতি।
অবশ্য শুধু মানব সভ্যতাই নয়, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রেও বড়োসড়ো প্রভাব ফেলতে চলেছে ‘ওসান ওয়ার্মিং’। গবেষকদের কথায়, ক্রমশ সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রাণ হারাচ্ছে বহু সামুদ্রিক জীব। কমছে সামুদ্রিক অণুজীবদের সংখ্যা। আগামীতে বহু প্রজাতি নিশ্চিহ্নও হয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণে। অন্যদিকে পরোক্ষভাবে সমুদ্রের উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত করবে বিশ্ব উষ্ণায়নকে, সে-ব্যাপারেও সতর্ক করছেন গবেষকরা। কারণ, মোট কার্বন নির্গমনের ২৫ শতাংশ কার্বন শোষণ করে সমুদ্র। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ক্রমশে কমছে কার্বন শোষণের মাত্রা। ফলে, আরও বাড়বে বৈশ্বিক তাপমাত্রা।
তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, কী কারণে আকস্মিকভাবে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সমুদ্রের তাপমাত্রা, তা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয় গবেষকদের কাছে। ফলে এই পরিস্থিতির প্রতিকার হিসাবে এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট পন্থার হদিশ দিয়ে উঠতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
Powered by Froala Editor