কী আছে পৃথিবীর গভীরে? সেখানে কি আজও ঘুরে বেড়ায় প্রাগৈতিহাসিক নানা জীবজন্তু? এই তথ্য খুঁজতেই নিজের বাড়ির মেঝে খুঁড়তে শুরু করেছিলেন প্রফেসর লিন্ডারব্রোক। সঙ্গে জুটে গিয়েছিল অ্যাক্সেল, হান্স, গ্রেচেল এবং মার্থা। সেখানে কি ঘুরে বেড়ায় প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু? হ্যাঁ, জুল ভার্নের সেই কিংবদন্তি কল্পবিজ্ঞান কাহিনির কথাই বলছিল। ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ আর্থ’। কিন্তু এই উপন্যাস লেখার প্রায় ১০০ বছর পর সত্যিই বিজ্ঞানীরা এমন অদ্ভুত কাণ্ড শুরু করেন। মাটি খুঁড়ে পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন ভূত্বকের নিচে অর্থাৎ ম্যান্টল বা গুরুমণ্ডলে। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সমকালীন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও।
পৃথিবীর গঠন সংক্রান্ত আধুনিক ধারণা অনুযায়ী ভূত্বকের নিচে আছে অর্ধতরল গুরুমণ্ডল। আর তার উপরে ভূত্বক সর্বত্র সমানভাবে বিন্যস্ত নয়। বরং টুকরো টুকরো অবস্থায় তা ভেসে বেড়ায়। তবে ১৯৫০-এর দশকে এই তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না অনেকেই। কিন্তু কীভাবে প্রমাণ করা যায়? প্রিন্সটন ইউনভার্সিটির অধ্যাপক হ্যারি হেসের মাথায় চাপল এক অদ্ভুত খেয়াল। তিনি একেবারে মাটি খুঁড়ে দেখিয়ে দেবেন গুরুমণ্ডলের অস্তিত্ব। ইতিমধ্যে অনুরূপ পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছেন স্ক্রিপস ইনস্টিটিউটের ভূ-পদার্থবিদ ওয়াল্টার মুঙ্ক। তবে তাঁর উদ্দেশ্য কিছুটা আলাদা। তিনি প্রমাণ করতে চান, বিজ্ঞানচর্চায় অন্য সমস্ত দেশের থেকে আমেরিকা অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে রাশিয়ার থেকে। কারণ সময়টাই যে ঠান্ডা যুদ্ধের।
পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হল মোহরোভিসিক প্রণালী। হ্যারি হেসের মতে সেখানে ভূত্বকের মধ্যে ফাটল রয়েছে। আসলে পাশাপাশি দুটি টুকরো এসে জোড়া লেগেছে এই অংশে। ফলে খননকার্য অনেকটাই সহজ হবে। হেসেলের ধারণা অনুযায়ী সমুদ্রতল থেকে মোটামুটি ৬ কিলোমিটার খনন করলেই পাওয়া যাবে ম্যান্টলের হদিশ। কিন্তু সমুদ্রের বুকে এমন একটা খননকার্য চালানো সহজ কাজ নয়। কাজ করতে হবে জাহাজের উপর থেকে। কিন্তু সেই জাহাজও একেবারে স্থির রাখা সম্ভব নয়। তাহলে? শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মার্কিন সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইলেন। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্যোগে তৈরি হল বিশেষ জাহাজ কিউজ-১। সম্পূর্ণ স্থির না হলেও সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যেও এই জাহাজ নিজের অবস্থান থেকে ৬০০ মিটারের বেশি দূরে যাবে না কখনোই। এমন একটা জাহাজ তৈরিও হইচই ফেলে দিয়েছিল সারা পৃথিবীজুড়ে।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে শুরু হল প্রথম পর্যায়ের খননকার্য। প্রোজেক্ট মোহোল। তবে প্রথমবার এমন একটা প্রকল্পে হাত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। খানিকটা জটিলতা তো হবেই। শেষ পর্যন্ত ৬ বছর ধরেও কাজ এগোচ্ছে না দেখে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয় আমেরিকা সরকার। তাছাড়া আরও নানা ধরণের জটিলতাও ছিল। সমুদ্রের মধ্যে এত বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি নিয়ে খননকার্য চালানোর ফলে সামুদ্রিক জীবদের ব্বিপদ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন বহু পরিবেশবিদ। এছাড়া পৃথিবীর বুকে কাটাছেঁড়ার বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংগঠনগুলির প্রতিবাদ তো ছিলই। তাছাড়া ততদিনে অ্যাপোলো স্পেস মিশনের দৌলতে মহাকাশযাত্রার জগতে আমেরিকার সাফল্য শুধুই সময়ের অপেক্ষা। এই সময় সমস্ত শক্তি দিয়ে চন্দ্রাভিযানকেই সফল করতে চেয়েছিল সরকার।
আরও পড়ুন
৪ হাজার বছর ধরে জ্বলছে আজারবাইজানের অগ্নিকুণ্ড!
তবে প্রোজেক্ট মোহোল বন্ধ হয়ে গেলেও ভূত্বক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ কিন্তু বন্ধ হল না। এবার এগিয়ে এল আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া। চন্দ্রাভিযানে রাশিয়াকে টেক্কা দিয়েছে আমেরিকা। অতএব ম্যান্টল খুঁজে বের করার কৃতিত্ব অর্জন করতে না পারলে তো সম্মান থাকে না। রাশিয়া-নরওয়ে সীমান্তের কাছে কোলা পেনিনসুলায় শুরু হল খননকার্য। সেটা ১৯৭০ সাল। আর এবারের পরীক্ষানিরীক্ষা সবটাই চলল গোপনে। পরবর্তী ১৪ বছর এই প্রকল্পের কথা রাশিয়ার বাইরে কেউ জানতেন না। তবে এবারেও ম্যান্টলের সন্ধান পাওয়া গেল না। ১৯৮২-৮৩ সাল নাগাদ যখন বিজ্ঞানীরা ১০ কিলোমিটারের বেশি গভীরতায় পৌঁছে গিয়েছেন, তখনই শুরু হল জটিলতা। মাটির নিচে বারবার আছড়ে পড়ছে সিসমিক তরঙ্গ। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সবকিছু। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মচারী দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন। এইসমস্ত সমস্যা সামাল দেওয়ার মতো প্রযুক্তি তখন পৃথিবীর কোনো দেশেই ছিল না। তার মধ্যেই ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটল। ১৯৯০ সাল থেকেই বন্ধ হয়ে গেল কোলা সুপারডিপ বোরহোলের কাজ।
আরও পড়ুন
এলিয়েনের ময়নাতদন্ত! ৭৪ বছরের পুরনো নেগেটিভ উসকে দিচ্ছে বিতর্ক
তবে এর মধ্যেই রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছিল রাশিয়া। কোলা অঞ্চলে ১২ কিলোমিটার গভীর গর্ত তৈরি করে ফেলেছিল তারা। এখনও অবধি মানুষের তৈরি সবচেয়ে গভীর গর্ত এটিই। রাশিয়া ও আমেরিকার দেখাদেখি প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল অন্যান্য দেশেও। ১৯৮৭ সালে পশ্চিম জার্মানি শুরু করেছিল অনুরূপ প্রকল্প। তবে সেখানে ৯ কিলোমিটার খননকার্যয চালানোর পরেই দেখা যায় উষ্ণতা পৌঁছে গিয়েছে ২৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এত উষ্ণতায় কোনো যন্ত্রপাতি নিয়েই কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে সেই প্রকল্পও ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয় জাপানের প্রকল্পও। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল, আজও হাল ছাড়েননি বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর অন্তর্গঠন সম্পর্কে তাঁদের প্রতিটা ধারণাই এখনও অবধি অনুমানমাত্র। কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তবে রাশিয়া বা জার্মানি অনেক গভীর গর্ত খুঁড়তে পারলেও আজকের বিজ্ঞানীদের মতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অবশ্যই মোহোল প্রকল্প। তার কারণ এর অবস্থান। যদিও সেখানে ১৮৭ মিটারের বেশি গভীর গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ৬ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছে যাওয়া অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে এই বিপজ্জনক পরীক্ষার বিষয়ে একমত নন সমস্ত বিজ্ঞানী। অনেকেই মনে করছেন গুরুমণ্ডল অবধি গর্ত খুঁড়তে গেলে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটে যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত কি পৃথিবীর অন্তর্গঠনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ অধরাই থেকে যাবে?
আরও পড়ুন
আইকিউ আইনস্টাইনের প্রায় দেড় গুণ, বিস্মৃতির অতলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব
Powered by Froala Editor