দিন কয়েক আগের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের প্রকাশিত এক রিপোর্ট দাবি করেছিল, চাঁদের বুকে জমি দখলের চেষ্টা করছে চিন। পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য দেশও। আগামীতে চাঁদে মানব-বসতি গড়ে তোলার স্ট্র্যাটেজিক লড়াই শুরু হয়ে গেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। শুধু চাঁদই নয়, মঙ্গলেও চলছে ভবিষ্যৎ শহর তৈরির প্রতিযোগিতা। এবার নীলগ্রহের বাইরে উপনিবেশ তৈরির আরও এক আশ্চর্য পরিকল্পনা দিলেন বিজ্ঞানীরা।
না, বৃহস্পতি, শনি কিংবা অন্য-কোনো গ্রহের উপগ্রহ নয়। বরং, সৌরজগতে ভেসে বাড়ানো গ্রহাণুর ওপরই নির্মিত হবে আস্ত শহর (Asteroid City)। সম্প্রতি প্রকাশিত হল এই আশ্চর্য ভাসমান শহরের তাত্ত্বিক নকশা। নেপথ্যে নিউইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের (Rochester University) গবেষকরা। ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড স্পেস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি।
প্রশ্ন থেকে যায়, ছোট্ট গ্রহাণুর ওপরই কীভাবে আস্ত একটি শহর নির্মাণ করবেন গবেষকরা? সেখানে যে পৃথিবীর মতো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রখর নয়। সেইসঙ্গে গঠনগত দিক থেকেও গ্রহাণু পৃথিবীর থেকে যথেষ্ট ভঙ্গুর। তবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ১৯৭০ সাল। হ্যাঁ, আজ থেকে ৫৩ বছর আগেই গ্রহাণু-শহর বা অ্যাস্টেরয়েড সিটি তৈরির কথা ভেবেছিলেন পদার্থবিদ জেরার্ড ও’নিল। গ্রহাণুতে ঘূর্ণন সৃষ্টি করে কৃত্রিমভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। তাত্ত্বিকভাবে এই শহরের আকার হওয়া উচিত চোঙাকার বা সিলিন্ড্রিকাল। তাঁর নকশা অনুযায়ী এই চোঙের ভেতরের বক্রতলেই মানব বসতি গড়ে ওঠার কথা।
ও’নিলের এই নকশা পরিচিত ‘ও’নিল সিলিন্ডার’ নামে। ইন্টারস্টেলার সিনেমাটি যদি দেখে থাকেন, তবে এই ‘ও’নিল সিলিন্ডার’-এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে পরিচিত আপনিও। এই সিনেমায় দেখানো ‘কুপার স্টেশন’ আদতে একটি ‘ও’নিল সিলিন্ডার’। যাই হোক না কেন, এই ধারণা তাত্ত্বিকভাবে চিত্তাকর্ষক হলেও, সমস্যা থেকে যায় অন্য জায়গায়। আর তা হল, গ্রহাণুর ভেতরে এ-ধরনের টানেল বা নল তৈরি করা এককথায় প্রায় অসম্ভব। কারণ ভঙ্গুর হওয়ায়, এই টানেল তৈরির সময়ই ভেঙে যেতে পারে আস্ত গ্রহাণুটি।
জেরার্ড ও’নিল নিজেও এই সমস্যার তাত্ত্বিক সমাধান খুঁজে দিতে পারেননি। এবার ৫০ বছর পর সেই জটিল ধাঁধাঁই সমাধান করেছেন রচেস্টারের বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কথায় সমাধান লুকিয়ে রয়েছে গ্রহাণুর ভঙ্গুরতাতেই। প্রধান গবেষক অ্যাডাম ফ্র্যাঙ্ক জানাচ্ছেন, গ্রহাণুতে শহর তৈরির জন্য প্রথমে কার্বন ন্যানোফাইবারের ব্যাগে দিয়ে গোটা গ্রহাণুকে মুড়ে ফেলতে হবে। তারপর উচ্চশক্তির ব্যবহারে ভেঙে ফেলতে হবে গোটা গ্রহাণুকে। তবে ‘মেস ব্যাগ’-খ্যাত কার্বন ফাইবারের এই ব্যাগের কারণেই মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে না গ্রহাণুর ধূলিকণা ও পাথরের টুকরো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই ব্যাগে কৃত্রিমভাবে ঘূর্ণনগতি প্রবর্তন করলেই পাথরের খণ্ডগুলি মেস ব্যাগের গায়ে জড়ো হয়ে চোঙের আকার ধারণ করবে। যার ভেতরে অনায়াসেই গড়ে তোলা যাবে শহর।
গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং এআই মডেলের মাধ্যমেই এই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে প্রমাণও করেছেন রচেস্টারের গবেষকরা। তবে বলার অপেক্ষা থাকে না, এই তাত্ত্বিক শহর গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি মানুষ। তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক দশক। তারপর হয়তো কল্পবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যেই ঢুকে পড়বে বাস্তব জগৎ…
Powered by Froala Editor