পুকুরের জলে ঢিল ছুঁড়লে তৈরি হয় বৃত্তাকার তরঙ্গ। পৃথক পৃথকভাবে তৈরি এমন দুটি তরঙ্গ উপরিপাতিত হলে, পুকুরের জলে তৈরি হয় এক বিশেষ নকশা। আদতে যা একটি নতুন তরঙ্গ এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে তার বিস্তার নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে কখনও হ্রাস, কখনও আবার বৃদ্ধি পায়। পদার্থবিদ্যার ভাষায় এহেন ঘটনাকে বলা যায় ব্যতিচার (Interference)। এবার এই অতি-পরিচিত ভৌতিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়েই সময় নির্ণয়ের সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন গবেষকরা।
অবশ্য সময় নির্ণয়ের (Time Measurement) এই পদ্ধতি ব্যতিচার-নির্ভর হলেও, আক্ষরিক অর্থে তার জন্য ঢিল ছুঁড়তে হয়নি কোনো জলাশয়ে। বরং, লেজারের রশ্মির ব্যবহারে ইলেকট্রনকে তরঙ্গায়িত করে ল্যাবরেটরিতে ব্যতিচার ঘটিয়েছিলেন গবেষকরা। বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক বরং।
যে-কোনো পরমাণুকে উচ্চশক্তি সরবরাহ করলে, তার শেষ কক্ষের ইলেকট্রন কক্ষপথ বদল করে। কেন্দ্রক থেকে দূরত্ব বাড়ে তার, সেইসঙ্গে গতিও। এ-অবস্থায় থাকা কোনো পরমাণুর আকারকে অনেকটা বেলুনের মতো কল্পনা করা চলে। যার অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি কক্ষপথ ফাঁকা। এবং শেষ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রয়েছে উচ্চশক্তি-সম্পন্ন একটি ইলেকট্রন। শেষ কক্ষের এই ইলেকট্রনটি উচ্চশক্তির কারণেই পৃথকভাবে তরঙ্গ বা কোয়ান্টাম প্যাকেটের মতো আচরণ করে। যা রিদবার্গ অবস্থা নামে পরিচিত। অন্যদিকে এইধরনের পরমাণুকে বলা হয় ‘রিদবার্গ অ্যাটম’।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদরা লেজার রশ্মির সাহায্যে সাধারণ হিলিয়াম পরমাণুকে উচ্চশক্তি সরবরাহকে ‘রিদবার্গ অ্যাটম’-এ পরিণত করেছিলেন তাদের। এহেন অজস্র রিদবার্গ পরমাণুর বাইরের কক্ষের ইলেকট্রন তরঙ্গ উপরিপাতিত হয়েই তৈরি হয় কোয়ান্টাম ব্যতিচার। নির্দিষ্ট ছন্দ মেনেই পরিবর্তিত হতে থাকে তার তরঙ্গ-বিস্তার। গাণিতিক পদ্ধতিতে সেখান থেকেই সময় নির্ধারণ করেছেন গবেষকরা।
না, কস্মিনকালেও আমাদের প্রচলিত হাতঘড়ি বা দেওয়াল ঘড়িকে প্রতিস্থাপিত করবে না সময় নির্ণয়ের এই নয়া-পন্থা। তবে গবেষণা এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর জগতে বিপ্লব আনতে পারে এই পদ্ধতি, এমনটাই অভিমত গবেষকদের। এতদিন পর্যন্ত সময় নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভুলতম পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহৃত হত পারমাণবিক ঘড়ি। তেজস্ক্রিয় মৌলের ক্ষয়ের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয় এই বিশেষ ঘড়ি। তবে তার থেকেও আরও নির্ভুলভাবে সময় নির্ণয় করতে পারবে রিদবার্গ অবস্থা বা রিদবার্গ স্টেটের ভিত্তিতে তৈরি ব্যতিচার ঘড়ি। ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র অনুযায়ী ৮১ পিকো সেকেন্ড পর্যন্ত সময় নির্ভুলভাবে গণনা করতে পারে এই ধরনের ঘড়ি। যা ১ সেকেন্ডের ১০ হাজার কোটি ভাগের প্রায় ৮০ ভাগ। পাশাপাশি এই ঘড়ি দিয়ে সময় পরিমাপের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সূচনাকালের প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ, আমরা সাধারণত সময় নির্ধারণের জন্য দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী দূরত্বকে প্রমাণ হিসাবে ধরে নিই। যেমন ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা ১১টার ঘর থেকে ১২টার ঘরে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী সময় এক ঘণ্টা। ব্যতিচার ঘড়ির ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে না এ-ধরনের কোনো প্রমাণ ঘটনার। কাজেই বলার অপেক্ষা থাকে না, গবেষণার ক্ষেত্রে যা অনেকাংশেই বাঁধনমুক্ত করবে বিজ্ঞানীদের। পদার্থবিদ্যার জগতে যার গুরুত্ব অপরিসীম…
Powered by Froala Editor