৫০-এর দশকেই পৃথিবীর বুকে শুরু হয়েছে নতুন যুগ! দাবি ভূতাত্ত্বিকদের একাংশের

একসময় পৃথিবীর বুকে রাজত্ব ছিল দৈত্যাকার ডাইনোসরদের। পৃথিবীর বুকে খসে পড়া উল্কার বিস্ফোরণে অবলুপ্ত হয়েছিল তারা। তারপর আবার নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল পৃথিবীর বুকে। জন্ম নিয়েছিল নতুন নতুন প্রজাতি। পৃথিবীর ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে এই দুর্ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং, নির্দিষ্ট সময়কাল পর পরই বদলেছে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি, জলবায়ু এমনকি প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতিরাও। এই বিশেষ সময়কালগুলি (Time Period) ভূতাত্ত্বিক ও নৃবিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ‘যুগ’ হিসাবে। কিন্তু যদি বলা হয় এমন দুটি পৃথক পৃথক যুগের সন্ধিক্ষণকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছে আজকের আধুনিক মানুষ? 

হ্যাঁ, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে এমনটাই। এতদিন মনে করা হত আমরা বসবাস করছি হলোসিন যুগে। আজ থেকে ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে পৃথিবীর বুকে ইতি পড়েছিল হিমযুগের। তারপরই শুরু হয়েছিল হলোসিন যুগ। উল্লেখ্য, এই সময়কালেই ক্রমে বিবর্তিত হয় আধুনিক মানুষ। তবে প্রায় ৮ দশক আগেই মানুষের অজান্তেই ইতি পড়েছে এই যুগের। বরং, পৃথিবীর বুকে শুরু হয়েছে এক নতুন যুগ। যার নাম ‘অ্যানথ্রোপোসিন ইপোক’। কিন্তু এই ‘অ্যানথ্রোপোসিন ইপোক’ (Anthropocene Epoch) বা ‘নৃতাত্ত্বিক যুগ’ আদতে কী? 

আজ থেকে দু’দশক আগের কথা। ২০০০ সালে নোবল-জয়ী জীববিজ্ঞানী ইউজিন স্টোমার এবং রসায়নবিদ পল ক্রুটজেন প্রথম সামনে এনেছিলেন এই বিশেষ শব্দবন্ধটিকে। দাবি করেছিলেন, শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর জলবায়ু, পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অম্লকরণ, মাটিক্ষয়, তাপ তরঙ্গের বিকিরণ-সহ একাধিক উদাহরণ। আর এইসমস্ত প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে খোদ মানুষেরই কার্যকলাপ। 

ইউজিন এবং পল সে-সময় সামনে রেখেছিলেন এক অদ্ভুত প্রস্তাব। চেয়েছিলেন, গবেষণা করে দেখা হোক এই বৃহত্তর ভূ-প্রাকৃতিক এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনের জেরে আদৌ পৃথিবীর বুকে নতুন যুগের সূত্রপাত হয়েছে কিনা। সেই উদ্দেশ্যেই পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভূ-তাত্ত্বিকদের নিয়ে গড়ে ওঠে একটি বিশেষ সংগঠন— অ্যানথ্রোপসিন ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এডব্লুজি। বিগত কয়েক বছর ধরে ‘যুগ পরিবর্তনের নমুনা’ সংগ্রহ করতেই প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে এই সংস্থা। আর সেই গবেষণা ও বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই সম্প্রতি তাঁদের দাবি বিশ্বে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নতুন যুগ, অবসান হয়েছে হলোসিনের। কিন্তু কী প্রমাণের ওপর ভর করেই এই দাবি তাঁদের?

ক্রফোর্ড লেক। কানাডার অন্টারিও প্রদেশে অবস্থিত ছোট্ট এই হ্রদ উত্তর আমেরিকার অন্যতম গভীর হ্রদ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রাথমিকভাবে গবেষণার জন্য এই হ্রদ থেকেই পলি সংগ্রহ করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। পলির স্তরের বিশ্লেষণে উঠে আসে, আনুমানিক ৭০ বছর আগে থেকেই বদলাতে শুরু করেছে পলির প্রকার। সেই পলিতে যেমন পাওয়া গেছে পারমাণবিক অস্ত্র, প্লাস্টিক পণ্যের সূক্ষ্ম কণা, তেমনই মিলেছে হারিয়ে যাওয়া বহু শৈবাল ও অণুজীবের নমুনাও। তবে শুধু এই হ্রদই নয়, বিশ্বের আরও ১১টি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত নমুনাও বলছে একই কথা। 

তবে কি সত্যিই নতুন যুগে বসবাস করছি আমরা? না, আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যানথ্রোপসিন যুগকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জিওলজিক্যাল সায়েন্সেস (আইইউজিএস)। প্রায় দশ লক্ষাধিক ভূ-তাত্ত্বিকদের নিয়ে গঠিত এই সংস্থা সবুজ সংকেত দিলে তবেই স্বীকৃত হবে এই নতুন যুগটি। তার জন্যই চলছে প্রস্তুতি। সম্প্রতি আইইউজিএস-এর শাখা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিউশন অফ স্ট্র্যাটিগ্রাফি’-তে গবেষকরা জমা দিয়েছেন তাঁদের গবেষণাপত্র এবং প্রমাণ। সেখান থেকে ছাড়পত্র মিললে তবে এই গবেষণাপত্র গৃহীত হবে আইইউজিএস-এ। আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যাবে সত্যিই নতুন যুগের সূচনা হয়েছে কিনা। অবশ্য এই ফলাফল না-আসার আগেও দিব্যি চোখ বুজিয়ে বলা যায় পৃথিবীর অতিদ্রুত পরিবেশগত পরিবর্তন মোটেও ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে না মানব সভ্যতাকে। বাহ্যিকভাবে দেখতে গেলে, শুধু বিশ শতকেই শত শত প্রজাতির অবলুপ্তিই যেন নিশ্চিত করেছে নতুন যুগের সূচনাকে। 

Powered by Froala Editor