আমি কুমারী দুর্গা বাগদি। ডাকনাম দুগগা। আমি থ্রি-র ক্লাসে পড়ি। রোজ সকালে উঠে চলে যাই ফুল তুলতে। ফুল তুলি আর মনসা বেদিতে এসে সাজিয়ে দি। আজ সকালে উঠেই বড়োবাড়ির বাগানের কাছে এসে দেখি - এ কী কাণ্ড! আমি আমার দিদি ফুলমণিকে ডেকেই যাচ্ছি কখন থেকে। কই রে ফুলমণি দিদি, দেখে যা, কত শিউলি ফুল ফুটে আছে, আয় দেখবি, আয়...
ও তোমাদের তো বলা হয়নি, ফুলমণি দিদি ফোর ক্লাসে পড়ে। আমি রোজ সন্ধ্যা হলে ফুলমণি দিদি কাছে পড়তে বসি। ছড়া পড়ি। অঙ্ক করি। আটের ঘরের নামতা না দেখে বলতে পারি। মুনিষ খেটে এই সপ্তাহে বাবা ৩৫০ টাকা পেয়েছে, আমি হিসাব করে বলে দিয়েছি খুব তাড়াতাড়ি, তাতে বাবা যে কী খুশি হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারব না। বাবার টাকা হিসাব করে দি বলে বাবাকে আমাকে বলে - 'আমার দুগগা এখন দিদিমণি হয়েছে'। আমারও খুব ভালো লাগে যখন বাবা আমাকে দিদিমণি বলে। আমি নিজেকে শ্রাবণী দিদিমণির মতো ভাবি। দিদিমণি কী সুন্দর বিনুনি করে চুল বাঁধে। কখনও নাল, কখনও লীল রঙের শাড়ি পরে আসে। দিদিমণিকে তখন কী সোন্দর লাগে! আমার তো বিনুনি নেই। শনিবার আমার চুলগুলো রতন কাকার সেলুনে গিয়ে ন্যাড়া করে দিয়েছে।
তাও আমি ইস্কুল শেষ হলে বাড়ি ফিরে আমার বাছুরটাকে পড়াই। তোমরা জানো আমার বাছুরটা নাম কী? ওর নাম ভুলি। ও শুধু ভুল যায় সবকিছু। সকালে যখন ওকে চা খেতে দিলেও ও খায় না। তারপর বেলা হলে যখন হরিণডাঙার মাঠ থেকে ঘাস কেটে আনি, তখন ও কী যে আনন্দ হয় তোমরা জানো না তা! এক বস্তা ঘাস খেয়ে নেয় ইয়া বড়ো হাঁ করে। তারপর ওর জিভ দিয়ে আমার হাতে সুড়সুড়ি দিয়ে দেয়। আমার খুব সুড়সুড়ি লাগে। কিন্তু ওকে আদর করতে গেলে তো দেরি হয়ে যায় ইস্কুল যেতে। কী করব বলো! বাবা তখন মুনিষ খাটছে মাঠে। মা গিয়েছে ভট্টাচার্য বাড়িতে কাজ করতে, ফিরতে সেই সন্ধেবেলা। ঘরে ঢাকা দেওয়া আছে ভিজে ভাত, লঙ্কাবাটা মাখা ঝাল সানা। মা সেই ভোরে উঠে রান্না করে, বাবা তখন গোরুগুলোর জন্য ছানি কাটে তারপর দুজনেই বেরিয়ে যায় কাজে।
আমি সব কাজ সেরে ভুলিকে আদর করে ছুটতে ছুটতে চলে যাই ইস্কুলে। ইস্কুল যেতে আমার খুব ভালো লাগে। ইস্কুলে কী সোন্দর ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, ডিম, মাংস কত কী দেয়! মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা কত গল্প বলে মজার মজার। ইস্কুলে আমার পাঁচজন বন্ধু আছে। কবিতা, রিয়া, স্বপ্না, তপতী আর মধুমিতা। আমরা ইস্কুলে একসাথে বসি, আবার একসাথে বসে খাই। আমাদের সব্বার একটা করে থালা আর গেলাস আছে। কেলাস শেষ হলে যখন ইস্কুলে ঘণ্টা বাজায় রমা মাস্টারমশাই। আমরা তখন একছুট্টে বসে পড়ি। দু দিকে সারি করে বসে পড়ি থালা গেলাস নিয়ে। সপ্তাহে দুদিন ডিম দেয় ইয়া বড়, একদিন মাছের খান দেয় একটা করে। আমি যখন টুয়ে পড়তাম তখন মাছের কাঁটা বাছতে পাড়তাম না, তখন শ্রাবণী দিদিমণি আমার মাছের কাঁটাগুলো বেছে দিয়েছিল। বাড়িতে শুধু ভাত আর লঙ্কা বাটা, নাহলে গচি মাছের টক করে রেখে দেয় মা। সন্ধ্যাতে বাবা তাস খেলে এসে বটা ময়রার দোকান থেকে চপ আনে আর মা গরম গরম ভাত চাপিয়ে দেয়। কিন্তু যখন ইস্কুল বন্ধ থাকে দোপরবেলা তখন খুব খিদে লাগে। পেটে লাগে। আমি তখন ভুলিকে আদর করি আর ভুলিও আমাকে চেটে দেয় গালে, হাতে।
আজ ভোরে ফুলমণি দিদিকে ডাকছি - কই রে ফুলমণি দিদি, শিউলি লিবি না। বেদি সাজাবি না? ফুলমণি সাড়া দিচ্ছে না। ওকে দেখাতাম কাঁন্দরের ধারে কত কাশফুল ফুটেছে। দেখাতাম ঘোষাল বাড়িতে মা দুগগা ঠাকুরের রং হচ্ছে। এই তো শনিবার ভোরবেলা টিভিতে মহালয়া হচ্ছিল ভোলন কাকাদের বাড়িতে। দুগগা পুজো চলে এল। আর দুদিন পর আমাদের ইস্কুলও বন্ধ হয়ে যাবে। কালকে টিফিন খাওয়ার পর শ্রাবণী দিদিমণিকে বলেছিলাম, 'দিদিমণি, ইস্কুল আবার কবে খুলবে?' দিদিমণি বলল – সেই লক্ষ্মীর পুজোর পর। আমি বললাম - 'এতদিন!' আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দিদিমণি বলল - তোরা কত ছুটি পাবি। খেলতে পারবি। পুজোতে মজা করবি। 'তারপর আমি শুধু বলেছিলাম - 'দিদিমণি দোপরবেলা ইস্কুল বন্ধ থাকলে আমরা কোথায় খাব? 'ও মা দেখি এত বড়ো দিদিমণি কাঁদছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত আদর করল। ছুটি হওয়ার পর দু পাতা টিপ, ফিতে, চুড়ি কিনে দিয়েছে। আমার যে কী মজা হল! কী মজা! দিদিমণি আমাকে খুব ভালোবাসে।
ও রে ফুলমণি দিদি, চল রে আর শিউলি ফুল তুলতে হবে না। চল এবার ভুলি জন্য ঘাস কেটে আনি চল। ওই দেখ ঢাক বাজছে, বিকাশ কাকা, সুবীর কাকা ঢাক বাজাচ্ছে। ওর কোলকেতাতে বাজাতে যাবে। ঘোষাল পাড়াতে কত আলো লাগাবে। বারোয়ারি তলাতে নবমীর দিন খিচুড়ি খাওয়াবে আর পুজোর কটা দিন আমি, ফুলমণি ভুলিকে আদর করবো, সন্ধেতে ঠাকুর দেখতে যাব।
কই রে ফুলমণি, পুজোর দিনে একবার ইস্কুল যাবি দোপরবেলা। যদি ইস্কুল খোলা থাকে। যদি কবিতা, স্বপ্নারা আসে ইস্কুলে... কই রে দিদি বল না, একবার যাবি?