দিবং নদীর ওপর জলাধার নয়, প্রশাসনের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও আন্দোলনে ইদু মিশমিরা

অরুণাচল প্রদেশ— ভারতের উত্তর পূর্বের ‘সেভেন সিস্টারস’-এর এক সিস্টার। পাহাড়, নদী, জঙ্গল সব মিলিয়ে প্রকৃতি ও মানুষের অদ্ভুত সহাবস্থান গড়ে উঠেছে এখানে। রাজ্যের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে দিবং নদী। অরুণাচলের মিশমিদের প্রাণ, শান্ত পরিবেশে এই নদীই সুন্দর সুর তৈরি করে দেয়। বেঁধে রাখে সকলকে।

ছন্দ তৈরি হয়, আবার সেটা ভেঙে ফেলারও মানুষ থাকে। দিবং নদী ঘিরে তেমনই ঘটনা ঘটে চলেছে। একটু পিছনে তাকানো যাক। ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি একটি নতুন প্রোজেক্ট উদ্বোধন করে ভারত সরকার। নাম, ‘দিবং মাল্টিপারপাস প্রোজেক্ট’ বা ডিএমপি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এটির শিলান্যাস করেছিলেন। এই প্রোজেক্টের মূল কেন্দ্রে ছিল অরুণাচল প্রদেশের এই দিবং নদী। ব্রহ্মপুত্রেরই তো একটি শাখা, প্রচুর জল; আর পাহাড়ি নদী হওয়ায় স্রোতের টান ভালোই। সেজন্যই এখানে জলাধার তৈরি করা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে সেখানে জলবিদ্যুতের বিশাল প্রকল্পও তৈরি হবে বলে ঘোষণা করা হয়।

এখানেই বেঁকে বসেন অরুণাচলের ইদু মিশমিরা। তাঁদের জমির ওপর, প্রাণের নদীর ওপর কিছুতেই বাঁধ তৈরি করতে দেবেন না। এর যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ কারণও আছে। দিবং নদীর আশেপাশেই মিশমিদের গ্রাম, চাষের জমি। সেই সঙ্গে আছে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। যদি জলাধার তৈরি করা হয়, তাহলে বিস্তর জমি লাগবে। আর তার জন্য কোপ পড়বে পরিবেশ, প্রকৃতি ও মানুষের পেটের ওপর। প্রায় ৫,৪০০ হেক্টর জমি সরকার দখল করবে; যার মধ্যে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি থাকবে বনভূমি। এছাড়াও থাকবে চাষের জমি, গ্রাম। এই সবকিছু তো ধ্বংস হবেই, সেই সঙ্গে বাঁধের পিছনে আরও কয়েক হাজার হেক্টর জমি জলের তলায় চলে যাবে। পরবর্তীতে বন্যা হলে তো আরও সমস্যা। তাও একটা দুটো বাঁধ নয়, ১৭টি বাঁধ! এক কথায় দিবং নদীর শান্ত অববাহিকা নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। আশ্রয় হারাবে মিশমিরা, প্রাণ যাবে বন্যপ্রাণীর।

একটা সময় প্রশাসন প্রভূত চেষ্টা করেছিল এটা সম্পূর্ণ করার। কিন্তু মিশমিদের সম্মিলিত প্রতিরোধে তা থমকে যায়। এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। ক্রমাগত ভয় দেখানো হচ্ছে তাঁদের। কেন্দ্রের দাবি, ওখানে ১৭টি জলাধার তৈরি করা হবে। যার ফলে ২০ মেগাওয়াট থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হবে। দেশের সর্বোচ্চ জলাধারটিও এখানেই নির্মাণ করা হবে। কিন্তু তারপর? এই মানুষগুলো কোথায় যাবে? কী হবে এখানকার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের? বাঘ, এশিয়ান গোল্ডেন ক্যাট, মিশমি তাকিন, গিবন-সহ প্রচুর প্রাণী স্রেফ হারিয়ে যাবে। সে ব্যাপারে একবারও ভেবেছে প্রশাসন ও কেন্দ্র? নিশ্চয়ই নয়…

আপাতত নিজেদের জমি বাঁচাতে, নিজেদেরকে বাঁচাতে আন্দোলনে নেমেছেন ইদু মিশমিরা। তাঁরা এত সহজে হার মানবেন না। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, কিন্তু এই লড়াই প্রকৃতিকে বাঁচানোর লড়াই। পুঁজিবাদের ভিড়ে সেসব যেন হারিয়ে না যায়। দিবংয়ের সন্তানরা আজ ময়দানে নেমেছে। লড়াই যে অনেক কঠিন…