সাল ২০১৩। প্রতি বছরের মতো ফ্রান্সে শুরু হয়েছে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে অসংখ্য ছবির মনোনয়ন আসে এখানে। সেখান থেকে সেরা ছবিগুলিই দেখানো হয়, পুরস্কার পায়। বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যশালী এই চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছে ভারতও। বেশ কিছু সিনেমা দেখানো হবে ওখানে। সেখানেই শোনা গেল আরও একটি সিনেমার নাম। পরিচালক বাঙালি। ছবিটিও বাংলার। সিনেমাটি জায়গা পেয়েছে ‘কানস ক্লাসিক্স’ বিভাগে। আসলে ১৯৬৪ সালে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। তারপর নানা সময় নানা পুরস্কারও পেয়েছে। আজও সমানভাবে সমাদর পেয়ে আসছে ছবিটি। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ, ২০১৩ সালে এই বিশেষ জায়গা পায়। ছবির নাম? ‘চারুলতা’। পরিচালক কে ছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই বলার দরকার নেই আর…
আরও পড়ুন
‘পথের পাঁচালী’র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়
কান চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের একদম শুরু থেকে সম্পর্ক। মনে করুন ১৯৫৬ সাল। ঠিক আগের বছরই সত্যজিৎ তৈরি করেছেন ‘পথের পাঁচালী’। দুই ভাই-বোন ও একটি পরিবারের গল্প। বাংলার গ্রামবাংলার নিটোল ছবি ধরা দিয়েছিল পর্দায়। এই ছবি করতে গিয়ে কত সমস্যা, ঝড়-ঝাপটা পেরোতে হয় সত্যজিৎকে, তা আর নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। কিন্তু সেই সবকিছুর স্বীকৃতি মিলেছিল বিশ্বের মানচিত্রে। ১৯৫৬ সালেই নবম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল’ হিসেবে জায়গা করে নেয়। এর পরের বছরই বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার জেতে ‘পথের পাঁচালী’।
আরও পড়ুন
সর্বজয়ার কান্নায় রবিশঙ্করের সুর, মুগ্ধ সত্যজিৎ বদল এনেছিলেন যে দৃশ্যে
সেখান থেকেই যাত্রা শুরু সত্যজিতের। এক বাঙালি সিংহের বিশ্বজয়ের গল্প। নিজের প্রথম সিনেমা থেকেই তিনি আন্তর্জাতিক। অনেকেই হয়ত এই তকমা পেয়েছেন। আসল ব্যাপার ছিল এটাকে জারি রাখা। সত্যজিতের সেই ধক ছিল। শুটিং ফ্লোরে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ক্যামেরার কাজটি দেখে নিচ্ছেন, সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করছেন; আর ফাঁকে ফাঁকে সিগারেটে টান দিয়ে ছকে নিচ্ছেন স্ক্রিপ্ট, এডিটিং। এমনটাই ছিলেন ভারতীয় সিনেমার ‘দ্য রে’।
আরও পড়ুন
প্রচ্ছদ থেকে পোস্টার – সবেতেই তুখোড় সত্যজিৎ; বানিয়েছেন চারটি ইংরাজি ফন্টও
১৯৬০ সালে আবার কানে ফিরে এলেন ‘দেবী’ নিয়ে। সেই সিনেমা দেখতে এসেছিলেন বার্গম্যান। সিনেমাটি দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। বিশেষ করে শর্মিলা ঠাকুরের ওই চোখ তাঁকে স্বপ্নেও তাড়া করে বেড়াত! উইলিয়াম ওয়েলার ও এলিয়া কাজানের মতে, ‘দেবী’ ছিল সেলুলয়েডে দেখা একটি কবিতা। এর পরের বছরই ‘তিন কন্যা’ও প্রশংসিত হয়। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত হল, যে ‘চারুলতা’ দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল, মুক্তি পাওয়ার পর কান চলচ্চিত্র উৎসবেই এটিকে বাতিল করা হয়। সত্যজিতের খারাপও লাগে; তবে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বার্গম্যান, স্যার ডেভিড লিনের মতো সিনেমাবোদ্ধারা। এমনকি, গোদারের কাছ থেকেও সম্যক প্রশংসা আদায় করেন সত্যজিৎ রায়। এই 'চারুলতা'ই পরে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার বিয়ার পুরস্কার পায়!
আরও পড়ুন
গুপীর চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র, রাজি হননি সত্যজিৎ
এর পরের কাহিনিটি একটু তিক্ততার। ষাটের দশকের শেষে কান চলচ্চিত্র উৎসবের তরফ থেকে সত্যজিৎ রায়কে জুরি হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বেশ কিছু কারণে সত্যজিৎ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। হয়তো তিনি সিনেমার বিচারকের আসনে নিজেকে দেখতে চাননি; যদিও এটা প্রচণ্ড বড়ো একটি সম্মান। কিন্তু সম্মানই কি সব? এছাড়াও সত্যজিৎকে একজনের ইকোনমি ক্লাসের বিমান টিকিট দেওয়া হয়। স্ত্রী বিজয়া রায়ের যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। এই পুরো ব্যাপারটাই সম্মানজনক মনে হয়নি সত্যজিৎ রায়ের। তিনি ফিরিয়ে দিলেন কানের জুরির পদ। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এরপর সত্যজিতের সিনেমা যেগুলো দেশ ও বিশ্বের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেগুলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা পায়নি। ১৯৮২ সালে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত প্রথম টেলিফিল্ম ‘সদগতি’ জায়গা পায় কানে।
আরও পড়ুন
বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল অসংখ্য চিঠি-ছবি, সামনে এল সত্যজিতের ‘গুপ্তধন’
তবে এখানে একটু বলা দরকার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কথাও। কানের পাশাপাশি এখানেও নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালি’ দিয়েই। আর ‘নায়ক’? ১৯৬৬-এর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশ্যাল জুরি অ্যাওয়ার্ড, ক্রিটিকস প্রাইজ পায় ছবিটি। সেরা সিনেমার জন্য মনোনীতও হয়েছিল ‘নায়ক’। এছাড়াও সত্যজিতের আরও দুটি সিনেমা বার্লিনের মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকবে। প্রথম হল 'মহানগর', যার জন্য আবার সিলভার বিয়ার জেতেন সত্যজিৎ; পরে 'অশনি সংকেত' একেবারে সেরার সম্মান এনে দিয়েছিল তাঁকে। পেয়েছিলেন গোল্ডেন বিয়ার!
এইভাবেই একের পর এক মঞ্চ জয় করেছেন সত্যজিৎ। শুধু পুরস্কার হিসেবে দেখলে হবে না; সেই সময়ের চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমালোচকদেরও প্রভূত প্রশংসা আদায় করেছিলেন তিনি। একসময় ব্রিটিশ পরিচালক ও সমালোচক লিন্ডসে অ্যান্ডারসন সত্যজিৎ সম্পর্কে বলেছিলেন, পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তিনি একজন। যার সিনেমা বদলে দিয়েছে দেখার ভাষা। এমনকি, আইনস্টাইন, চ্যাপলিন, বার্গম্যান, কুরোসাওয়ার সঙ্গে একই আসনে বসিয়েছিলেন ‘দ্য মায়েস্ত্রো’-কে। মহারাজাকে সেলাম না জানালে হয়!