‘পথের পাঁচালী’ ততদিনে মুক্তি পেয়ে গেছে। বাংলা সিনেমা তো বটেই, ভারতীয় সিনেমায় যে নতুন যুগের সূচনা হয়ে গেছে, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন সবাই। এরই মধ্যে সত্যজিৎ রায় শুরু করলেন অপু’র জীবনের পরবর্তী পর্যায় নিয়ে ছবি ‘অপরাজিত’-এর কাজ। কিন্তু কিশোর অপু কে হবে? একটি কলেজ পেরনো, অভিনয়-পাগল ছেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কিন্তু এ যে বেশ কিছুটা বড়ো, তার ওপর লম্বাও! নাকচ করে দিলেন ছেলেটিকে। কিন্তু সত্যজিতের অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই মেপে নিয়েছিল ছেলেটিকে। তারপর জন্ম হল ‘অপুর সংসার’-এর, সত্যজিতের হাত ধরে রুপোলি পর্দায় পা রাখল ছেলেটি। নতুন করে জন্ম হল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামক এক কিংবদন্তির।
নিজের নানা সাক্ষাৎকারে, আলোচনায় এই গল্পটি করেছেন সৌমিত্র। তাঁকে দেখেই নাকি ‘অপু ট্রিলজি’-এর তৃতীয় গল্পটির ভাবনা আসে ‘দ্য মায়েস্ত্রো’র। ৮৫ বছরের জীবনে আজও ফিরে আসে সেই স্মৃতি, সেই মুহূর্তগুলো। সত্যিই তো, বাংলা সিনেমা কালে কালে অনেক জুটিই দেখেছে। কিন্তু পরিচালক-অভিনেতার এমন সফল ও হিট জুটি খুব একটা এসেছে? ‘অপুর সংসার’ দিয়ে শুরু, শেষ ‘শাখা-প্রশাখা’ দিয়ে। সত্যজিৎ-সৌমিত্র পর্দায় এলে আজও নস্টালজিয়ায় ভোগে বাঙালি।
ছবির ক্ষেত্রে পরিচালককে জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবেই মনে করেন সৌমিত্র। পরিচালক কোনো প্রশাসক বা নেতা নন। বরং ছবি নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁদেরকে দক্ষভাবে নিজের চাওয়াটাকে বোঝানোই তাঁর অন্যতম কাজ। সেই ক্ষেত্রে শুধু ছবি তৈরি করলেই হয় না, সমস্ত বিভাগের ওপর সমান যত্ন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। আর এই সমস্তটাই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে। শুটিংয়ের সময় অভিনেতার চুলও অনেক সময় নিজের হাতে ঠিক করে দিতেন তিনি। অভিনয়ের আগে উৎসাহ দিতেন, খুঁটিয়ে আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখতে বলতেন। নিজের চিন্তা অনুযায়ী কাজ করলেও, অভিনেতাকে তাঁর জায়গা ছেড়ে রাখতেন। আর সেটা অনেকটা অনুপ্রাণিত করত অভিনেতাদের। অন্তত তাঁর নিজের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে বলে মনে করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একে অপরের কাছ থেকে কী চান, কতটা পাবেন, সমস্ত কিছুই বুঝে নিতেন।
তখনও ‘অপুর সংসার’-এর কাজ শুরু হয়নি। নবাগত সৌমিত্র’র ক্যামেরা ভীতি কাটানোর জন্য অন্যান্য শুটিংয়ে তাঁকে নিয়ে যেতেন সত্যজিৎ। এরকমই একটা জায়গায় একবার ক্যামেরা টেস্ট নেওয়া হয় সৌমিত্র’র। কেন এই টেস্ট, কীসে লাগবে, সেসব কিচ্ছু কোনোদিন বলেননি সত্যজিৎ। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণে সৌমিত্র’র মনে হয়েছে, তাঁর জড়তা কাটানোর জন্যই ওটা করেছিলেন তিনি। তাঁকে সাহায্য করার জন্যই ওই টেস্ট ছিল। নয়তো নিজের বাড়িতে বসে স্কেচ করেও সত্যজিৎ দেখে নিতে পারতেন; অনেক সময় সেটা করতেনও।
সিনেমার চরিত্রটির চেহারা সম্পর্কে কতটা মনোযোগী ছিলেন সত্যজিৎ, সেটা শুরু থেকেই বুঝেছিলেন সৌমিত্র। এই সম্পর্কে সত্যজিতের ছিল কিংবদন্তিতুল্য নিষ্ঠা। এই প্রসঙ্গে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর গল্পটির কথা বলা যায়। সৌমিত্র’র সঙ্গে বসে অনেক ছবিরই চিত্রনাট্য আলোচনা করতেন সত্যজিৎ। সেরকমই ‘গুগাবাবা’-র চিত্রনাট্য পড়ার পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো বদ্ধপরিকর গুপী হওয়ার জন্য। বারবার অনুনয়ও করেন। কিন্তু সত্যজিৎ কিছুতেই রাজি হননি। মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন- “তোমাকে দেখে কোনো দিক থেকেই কৃষকের ছেলে বলে মনে হয় না।” পরবর্তীকালে অবশ্য তপেন চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখার পর মত বদলেছেন সৌমিত্র। ওইরকম অভিনয় করা যে তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না, সেই কথাও স্বীকার করেছেন একাধিকবার।
সত্যজিৎ-সৌমিত্র’র কথা হবে, আর ফেলুদা আসবে না, তা কি হয়? বহু বাঙালির কাছে আজও একমেবাদ্বিতীয়ম ফেলুদা হলেন সৌমিত্র। অনেক বইয়ের কভারেও ওঁর মুখের আদল বসানো। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও একপ্রকার স্বীকার করেন সেই কথা। তবে সত্যজিতের শুরুর দিককার স্কেচে সেই ব্যাপার ছিল না, পরে এসেছিল। নিজের জীবনে দুটি ফেলুদার ছবিতে অভিনয় করলেও, তাতেই চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে গেছেন। তাঁর মতে, “ফেলুদা, আমি আর সত্যজিৎ রায় ছিলাম একটি সুখী ত্রিভূজীয় প্রেমকাহিনির তিনটি চরিত্র।” শুধু কি ফেলুদা? ‘হীরক রাজার দেশে’-র উদয়ন পণ্ডিত, ‘ঘরে বাইরে’-র সন্দীপ, ‘চারুলতা’-র অমল, ‘অশনি সংকেত’-র গঙ্গাচরণ— একের পর এক রূপে তাঁকে পেয়েছি আমরা। আজও সেই দূর থামেনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। পর্দায়, মঞ্চে সমান তালে দাপিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু একটা চরিত্রকে বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা, তার ভেতরে ঢুকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর জিনিসগুলোকেও এড়িয়ে না যাওয়া, এই শিক্ষাগুলোর জন্য তিনি আজও ফিরে যান সত্যজিতের কাছে।
ঋণস্বীকার-
১) অগ্রপথিকেরা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
২) রোর বাংলা, সাক্ষাৎকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়