‘এইটা সিকিমে’, ‘এইটা জয় বাবা ফেলুনাথ-এর শুটিং করতে গিয়ে বেনারসে’, ‘এইটা ওই যোধপুরের সার্কিট হাউসে রাতের দৃশ্যটা শুট করার সময় লাইট টেস্ট করছি’ – আমি একটার পর একটা ছবি দেখাতে থাকি, আর তিনি বলে চলেন। প্রত্যেকটি ছবির খুঁটিনাটি তাঁর কণ্ঠস্থ। এ যে তাঁর ফেলে আসা স্বর্ণময় অতীতের আকরসন্ধান। কয়েক কেজি ওজনের, তাঁর এই অ্যালবামটা যেন নিছক ছবি-বই নয়, তা এক স্মৃতিমেদুর খনি। যে খনির সবটাই ধরে রাখতে ইচ্ছে করে লেন্সে।
বালিগঞ্জে তাঁর এগারো তলার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে শরতের শেষ রোদ্দুর এসে পড়েছে তখন। সাজানো ছবিগুলো থেকে একটার পর একটা ছবি তুলতে থাকি। কখনও মোবাইলে, কখনও ডিজিটাল ক্যামেরায়। সামনের আর্মচেয়ারে বসে আমার কাজ দেখতে থাকেন তিনি। সোফায় বসে ছবি তুলতে তুলতে কখনও একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাই, কখনও উঠে বসি সোফার হাতলে। সেসবই চোখে পড়ে তাঁর, হয়ত বেশ উপভোগই করেন। মাঝে মধ্যে দু-একটা প্রশ্ন করেন। বেশিরভাগ সময় অবশ্য প্রশ্নটা আমিই করি। আসলে, বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা এই ‘মাটির মানুষ’টার কাছে থাকার সুযোগটা যেন হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। অসমবয়সী দুই মানুষের সেই কথোপকথন, আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা, কখনও ভুল হলে মৃদু বকুনি, সব মিলিয়ে বেশ জমজমাটই হয়।
এতক্ষণ যাঁর কথা বলছিলাম, তিনি সৌম্যেন্দু রায়। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, এম. এস. সথ্যু, রাজা সেন-সহ প্রথম সারির একাধিক পরিচালকদের ছবিতে ক্যামেরার পিছনে পরম ভরসার মুখ তিনি। যে কঙ্কালরূপী মণিমালিকাকে দেখে শিউরে উঠেছি, কিংবা মরুভূমির হলুদ পটভূমিকায় কয়লার ধোঁয়ার ট্রেন থামাতে প্রদোষ মিত্তিরের যে ব্যর্থ হওয়া দেখে হতাশা জেগেছে মনে, সেসব কাজের পিছনে থাকা লোকটাই আমার সামনে বসে আছেন। কাজের সূত্রেই তাঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু আমার। এর আগেও বেশ কয়েকবার আসা হলেও তাঁর সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল সেইদিন প্রথম। ছবির শুটিংয়ের নানা গল্প তাঁর মুখে প্রচুর শুনে ফেলেছি তার আগেই। হীরক রাজ্যের রাজকোষের চারপেয়ে পাহারাদারটির মালিকের ত্রিশ বছর দাঁত না মাজা, ‘উম্মা’ নামের সেই বাঘিনীর সামনে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়াতে তার বিরক্ত হয়ে তেড়ে ওঠা, পাহাড়ী সান্যালের ফরাসি-জ্ঞান নিয়ে ছবি বিশ্বাসের ঠাট্টা, দক্ষিণের ছবিতে কাজ করতে গিয়ে মেক-আপ নিয়ে মজার সব ঘটনা – গল্পের স্টক তাঁর ফুরোয় না। সেদিনও এমনই সব গল্প হতে হতে হঠাৎই আমাদের কথার মধ্যে এসে পড়েছিলেন চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।
দুজনেরই জন্মদিন ৭ ফেব্রুয়ারি। বিনোদবিহারী ১৯০৪, সৌম্যেন্দু ১৯৩২। দুজনেই ছবির জগতে নিজেদের নিমগ্ন করেছেন, হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। তফাতের মধ্যে একজনের হাতে ছিল রং-তুলি-কাগজ, আরেকজনের চোখে ছিল লেন্স। কিন্তু দ্বিতীয় জন নিজেই লিখেছেন, ফোটোগ্রাফি বুঝতে গেলে আগে পেন্টিং বোঝা জরুরি। ফোটোগ্রাফির সংজ্ঞা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনটি শব্দে – ‘Painting with lights’। অতএব, দুই ‘বার্থডে বয়’-কেই যদি চিত্রশিল্পী বলা যায়, তাহলে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। কর্মপথে চলতে চলতে দুজনের হঠাৎই দেখা হয়েছিল। এক চিত্রকর তাঁর ক্যামেরায় ধরলেন আরেক চিত্রকরকে। এমন অদ্ভুত সমাপতন, তা নিয়েই সৌম্যেন্দু রায়কে আমি সেদিন বেশ উৎসাহিত হয়ে বলেছিলাম – ‘স্যার, আপনার জন্মদিন ৭ ফেব্রুয়ারি, না? জানেন, ওদিন আরও একজন বিখ্যাত শিল্পীর জন্মদিন, যাঁকে আপনি ক্যামেরায় ধরেওছেন। তিনি বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।’ শুনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল ‘স্যারের’ মুখ – ‘তাই নাকি গো? বাহ, এটা তো জানতুম না।’
সালটা ছিল ১৯৭২। বিনোদবিহারীর উপর তথ্যচিত্র বানালেন সত্যজিৎ রায়। শান্তিনিকেতনের পাঠ অসমাপ্ত রেখে আসা ছাত্রটি তখন বিশ্ববিশ্রুত চিত্র-পরিচালক। শারীরিকভাবে বিনোদবিহারী তখন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন। কিন্তু, যে বিশেষ সত্তাটি তিনি আজীবন ব্যবহার করেছিলেন চিত্রকলায়, সেই খুঁটিয়ে দেখার চোখ কি আর সহজে নষ্ট হয়। ছোট থেকেই মায়োপিয়ার শিকার ছিলেন তিনি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তিনি অচিরেই অনন্য হয়ে ওঠেন তাঁর ছবির বিষয়বস্তুর জন্যই, যা কিনা ছিল আশেপাশের বাস্তবদৃশ্যেরই পরিস্ফুটন। অবসরে বোলপুরের রুক্ষ, গ্রাম্য পরিবেশের মাঝে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতেন প্রতিটি পাখি কিংবা প্রতিটি চারপেয়ে জন্তুর নড়াচড়া। কিশোর বয়সেই তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষক তথা বিজ্ঞান-লেখক জগদানন্দ রায়ের ‘পোকা মাকড়’ বইয়ের অলংকরণের জন্য কেঁচো-কেন্নোর ছবি এঁকে দিয়েছিলেন নিখুঁতভাবে। সেসময় জগদানন্দ রায়কে বেশ ভয়ই পেতেন তিনি। সেই জগদানন্দ রায়ই তাঁর আঁকা দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন, যে স্বয়ং রবিঠাকুরকে অবহিত করেন এই বিস্ময় বালকের চিত্রশিল্পের দক্ষতা সম্পর্কে।
বীরভূমের খরতপ্ত গ্রীষ্মের ছবিতে তিনি শুধুমাত্র বিষয় রাখছেন তিনটি খেজুর গাছকে। সেখানে রঙের ব্যবহারেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন দাবদাহের প্রখরতা। তরুণ বয়সে আঁকা একটি সেতুর ছবিতে তিনি যে নিজস্বতা দেখিয়েছিলেন, তেমনটা আগে কেউ দেখাতে পারেনি। তাঁর নিজস্বতাকে ফুটিয়ে তোলার পর্যাপ্ত পরিসর দিয়েছিলেন নন্দলাল বসু। একবার একটি ছবি দেখে বন্ধুরা বলেন, রঙের কম্পোজিশনে ভুল। সেই ছবিটি কেটে ফেলেন বিনোদবিহারী। নন্দলাল পরে এসে সেই ছবি নিয়ে গিয়ে তাঁর সেই বন্ধুদের বুঝিয়েছিলেন, কোনও কম্পোজিশনের ভুল নেই। তবে প্রথমদিকে তাঁর রঙের ব্যবহারে অপরিচ্ছন্নতা থাকত। জোড়াসাঁকোয় দুই দিকপাল শিল্পীকে একদিন নিজের আঁকা ছবি দেখাতে গিয়েছিলেন বিনোদবিহারী। অপরিচ্ছন্নতা দেখে অবন ঠাকুর অসন্তুষ্ট হলেও বড়দাদা গগন ঠাকুর সহজাত ক্ষমতাটিকে ঠিকই চিনেছিলেন। সেই নিয়ে ভাইকে খানিক তিরস্কারও করেন যে, প্রত্যেকে তার নিজের মতো করে ছবি আঁকবে। শারীরিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শিল্পীজীবনের শুরুতেই প্রতিষ্ঠানতুল্য মানুষদের কাছে এমন দরাজ সার্টিফিকেট যিনি পান, তিনি নিজেও যে কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন, এতে আর সন্দেহ কী!
সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, সেসময় তিনি নতুন এক ধরনের শিল্প-মাধ্যমে মনোনিবেশ করেছেন। মোমের জিনিস বানাতে শুরু করেছেন তখন। সত্যজিৎ তথ্যচিত্রের ভাষ্যপাঠে বলেছিলেন – ‘A lesser man might have been crumbled under the impact of the tragedy. But Benode Behari went on to prove that, even for a visual artist, loss of sight need not be in there in the creation, that there was an inner eye, an inner vision, born of long experience and deep devotion.’ রঙিন কাগজের কোলাজ বানাচ্ছেন, কাগজে ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করছেন ফেল্ট পেন। কেবলই অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা তাঁর এই নিখুঁত অঙ্গুলিচালনাকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন যে মানুষটি, তিনিও সততই মুগ্ধ হয়েছিলেন শিল্পীর অক্লান্ত সত্তার দিকে তাকিয়ে।
বিনোদবিহারীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, জানতে চেয়েছিলাম। সৌম্যেন্দু রায় মাত্র কয়েকটা কথায় পুরো সারবত্তাটাই বলে দিয়েছিলেন – ‘তখন উনি ওই যে ফ্রেস্কোগুলো করছিলেন, একদম অ্যাকিউরেট, একটুও এদিক-ওদিক নেই। মানিকদা যে ইনার আই নামটা দিয়েছিলেন, আমার মনে হয় ওর চেয়ে ভালো নাম আর হত না।’
Powered by Froala Editor