প্রচ্ছদ থেকে পোস্টার – সবেতেই তুখোড় সত্যজিৎ; বানিয়েছেন চারটি ইংরাজি ফন্টও

মাঠজুড়ে ফুটে আছে অসংখ্য কাশফুল। ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তে। তারই মাঝখানে বসে আছে দুজন। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। বয়স কারোরই বেশি না। দেখে মনে হয়, ভাই-বোন। ছেলেটির মাথায় একটি মুকুট। ঠিক যেন বালক রাজা সেজেছে! হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল ওরা। দূর থেকে একটি ট্রেন ছুটে আসছে। কালো কালো ধোঁয়াগুলো একটু উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে রোদের সঙ্গে। ছেলে-মেয়েদুটো সেই দিকেই দৌড়ে গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যই রিলবন্দি করে নিচ্ছেন একজন লম্বা মতন লোক। কয়েকবছর পরই যে দৃশ্য বাংলার ঘরে ঘরে ঘুরবে। ‘পথের পাঁচালী’ কি নিছকই একটি চলচ্চিত্র?

এ তো গেল সিনেমার কথা। কিন্তু উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি এইসব দেখিয়ে যাচ্ছেন, এই প্রতিবেদনের আলো এবার তাঁর ওপরেই পড়বে। তখনও তিনি ‘দ্য সত্যজিৎ রায়’ হননি। একজন নবাগত পরিচালক। কিন্তু দুই চোখে অপার স্বপ্ন। শুধু চলচ্চিত্রকার, লেখক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক— এইসব পরিচয়ে শেষ হয়ে যান না সত্যজিৎ। এর বাইরেও রয়েছে আরও কিছু দিক। একজন প্রচ্ছদশিল্পী, ক্যালিগ্রাফার, অক্ষরশিল্পী হিসেবেও তিনি একইরকম দক্ষ। সেইদিক থেকেও বাংলার শিল্পজগতে সত্যজিৎ রায় স্মরণীয়…

একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। তিন বছর বয়সেই পিতৃহারা হন সত্যজিৎ। কিন্তু কথায় বলে না, বংশ পরম্পরা নষ্ট হয় না! সত্যজিতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তাঁর বাবা সুকুমার রায় এবং ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দুজনেই ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও শিল্পজগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। নতুন করে এটা বলার কিছুই নেই। সেই সঙ্গে ছিল ক্যালিগ্রাফি, মুদ্রণ শিল্প। সেই সমস্ত কিছুর উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। সেইসঙ্গে ছিল শান্তিনিকেতন। পড়াশোনার সূত্রে সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের চিত্র, শিল্পও বেড়ে ওঠে তাঁর মধ্যে।

১৯৪৩ সাল। তরুণ সত্যজিৎ ঢুকলেন ব্রিটিশ অ্যাড সংস্থা ডি জে কেইমারে; একজন জুনিয়র ভিসুয়ালাইজার হিসেবে। অ্যাডের জন্য ছবি আঁকা তো বটেই, ফন্ট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার শুরুটা সেখান থেকেই। খুব স্বাধীনভাবে এখানে করতে পারতেন না; কিন্তু যেটুকু পারতেন ঢেলে দিতেন নিজেকে। ব্যক্তিগত ভাবেও চলতে থাকে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কারসাজি। পরে ১৯৪৫-এ যখন ডি কে গুপ্ত’র ‘সিগনেট প্রেস’-এর প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যুক্ত হন, তখন এই কাজ, পরীক্ষা নিরীক্ষা আরও বাড়তে থাকে। প্রচ্ছদ তৈরি করা তো বটেই, সেখানেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের বিপুল জগতের মধ্যে আসা। এই কাজ করতে করতেই হাতে আসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী-র কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’। বাকি গল্পটা গোটা বিশ্ব জানে…

নিজের সিনেমার পোস্টার হোক, বা সন্দেশের পাতায় ছবি, ফেলুদার সজ্জা— সবই নিজের হাতে করতেন সত্যজিৎ। এবং তাঁর অভিনবত্ব ও বিস্তার কতটা ছিল, সেটা দেখা যাবে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘দেবী’, ‘সীমাবদ্ধ’ ইত্যাদি সিনেমা ও গল্পের ছবিগুলো দেখে। এক একটি কাজ যেন স্বতন্ত্র; ওই গল্প অথবা সিনেমাটিকেই ফুটিয়ে তুলছে। সাহিত্য অকাদেমি, নন্দনের লোগোর কথা কি ভোলা যাবে এত সহজে! সব জায়গায় অক্ষর আর ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেছেন সত্যজিৎ। যত ভেঙেছেন, ততই নতুন রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে সেই চেনা বর্ণমালাই।

ভারত ও বাংলার ক্যালিগ্রাফির অদ্ভুত সুন্দর জগতটিকে সবার সামনে নিয়ে আসেন সত্যজিৎ। এই কাজ করতে করতে নিজেও তৈরি করে ফেলেন চার চারটি নতুন ফন্ট— রে রোমান, বিজার, ডাফনিস ও হলিডে স্ক্রিপ্ট। এই চারটিই সত্যজিৎ-আবিষ্কৃত। আজও সমানভাবে এগুলো ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে, রে রোমান আর বিজার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়। ১৯৭১ সালে একটি ইন্টারন্যাশনাল ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় এই দুটি ফন্ট জয়লাভ করে। এই চারটি ফন্টই ইংরেজিতে। কিন্তু বাংলায়ও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। বেশ কিছু অক্ষরকে নতুন স্টাইল দিয়েছিলেন। এখনও ‘সত্যজিতের স্টাইল’ নামেই বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থায় ব্যবহৃত হয় সেগুলো। বাংলা ও ভারতে টাইপোগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফির আধুনিক জগতের শুরুটা করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাংলা সিনেমাতেই হোক, বা তার পোস্টার, বইয়ের কভার— সবেতেই ছড়িয়ে আছেন তিনি। ছড়িয়ে আছে তাঁর শিল্পবোধ, অলংকরণ, অক্ষরসজ্জা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More