“আমি যা যা কাজ করি সেগুলো মূলত আমার নিজস্ব মতামত। কোনো পার্টির প্রতিই আমার কোনো ওরিয়েন্টেশন নেই। তবে বিষয় হল এখন রাজনীতিতে অদ্ভুত জিনিসপত্র হয়। আসলে বিষয়গুলো তো যথেষ্ট সিরিয়াস। সিরিয়াসলিই সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু এই সিরিয়াসনেসটা সব সময় ভালোও লাগে না, তাই সেটাকে একটু মজার মোড়কে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।”
বলছিলেন মাহফুজ আলি। তবে এই নামটা অনেকের কাছেই অপরিচিত। বরং ‘মালি’ বললেই একবাক্যে তাঁকে চিনে ফেলবেন যে কেউ। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম বাঙালি কার্টুনশিল্পী তিনি। কখনও তাঁর আঁকা কার্টুনে প্রতিফলিত হয়েছে বসন্তের রং, নির্মেদ মজা আবার কখনও মায়াময় দিনযাপনের ছবি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দাঁড়িয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন। তা নিয়েই চলছে জোরদার তরজা। তবে এই সিরিয়াস, গুরু-গম্ভীর পরিস্থিতিতেও মানুষের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলছেন মালি। হাতিয়ার শিল্প। হাতিয়ার ব্যঙ্গচিত্র। তাঁর কার্টুনেই প্রতিফলিত হচ্ছে বিশ্বের সর্ব-বৃহৎ ডেমোক্রেসির কমেডি।
শুধু তো আজ নয়। কার্টুনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস। একেবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল ওয়ারের সময় থেকে যা অঙ্গ হয়ে এসেছে রাজনীতির। থমাস ন্যাস্টের হাত ধরেই পৃথিবী দেখেছিল মার্কিন প্রদেশের দুই বৃহত্তম শক্তিকে হাতি-গাধার মাধ্যমে উপস্থাপনা। ফ্রান্স, ইতালি, ব্রিটেনের কথা নয় বাদই থাকল। বাংলার রাজনীতিতেও কার্টুনের প্রভাব দীর্ঘকালীন। তা দেওয়াললিখনই হোক বা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো রাজনৈতিক তরজা।
“আমার মনে হয় রাজনীতির ওপর এটার সরাসরি কোনো প্রভাব নেই। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কার্টুন একটা সময়ের ডকুমেন্টেশন হয়ে থেকেছে। আমিও সেটাই মনে করি, আমার কার্টুনগুলো কোনো প্রভাব ফেলবে না কারোর ওপরেই। তবে এখনকার পরিস্থিতির একটা দলিল হয়ে থেকে যাবে। কারণ, মিডিয়ার মধ্যে বায়াসনেস চলে আসে অনেক সময়ই। তেমনটা সবসময় নাও হতে পারে, হয়তো আমরা নিজেরাই পক্ষপাতদুষ্ট। সেই কারণে ফ্যাক্টটা তুলে আনার চেষ্টা করাটাই ভালো। সেই জায়গাটাতেই সতর্ক থাকি, যাতে নিজে ফেক নিউজ ছড়িয়ে না দিই আমি”, বলছিলেন মাহফুজ আলি।
তবে কার্টুন নিয়ে এমনই সব দৃষ্টান্তমূলক ফুল ফুটিয়ে চলেছেন যিনি, সেই ‘মালি’-র কিন্তু কোনোরকম পেশাগত যোগাযোগ নেই এই শিল্পটির সঙ্গে। পেশাগতভাবে একজন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট তিনি। আহমেদাবাদে থেকে পড়াশোনা করার পর তিনি কাজ করেছেন কলকাতা-সহ ভারতের একাধিক শহরে। বর্তমানে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে কার্টুনের জগতে আসা কীভাবে?
“ছোটবেলায় যে গ্রামে থাকতাম, সেখানে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। কার্টুনের সঙ্গে পুরো সম্পর্কটাই ছিল বইয়ের মধ্যে দিয়ে। বাবা সেসময় কৃষ্ণনগর থেকে আনন্দমেলা নিয়ে আসতেন। সেখানে বিভিন্ন কমিক্স দেখে সেইসব চরিত্রদের ছবি আঁকতাম। তাছাড়াও টিনটিন তো ছিলই। পরবর্তীকালে কলেজে যখন পড়ি তখন শিক্ষকদের ছবি আঁকা দিয়েই কার্টুনের শুরু। বন্ধুবান্ধবদের উৎসাহ পাশে ছিল সবসময়। পরে যখন চাকরিতে জয়েন করি তখন কলিগদের জন্মদিনের কার্ড বানাতাম। দেখলাম, সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে দাঁড়িয়েছে”, স্মৃতিচারণ করছিলেন মাহফুজ আলি। প্রথমে দু-একটা ছবি বিক্ষিপ্তভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করতেন তিনি। পরে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিকভাবেই শুরু হয় কার্টুন-প্রকাশ। মাহফুজ আলি থেকে মালি হয়ে ওঠা সেই সময়েই।
তবে কিছু বছর আগে পর্যন্তও আমরা যে কার্টুন দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, তা হল ছাপা ফর্ম। সাদা-কালো। কখনও বা রঙিন। তবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে কার্টুনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি আমরা সেটা সম্পূর্ণই আঁকা ডিজিটাল মাধ্যমে। তবে কি প্রযুক্তির দৌলতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কার্টুনের আদি ফর্মটাই? উত্তর দিলেন তিনি, “ডিজিটাল হোক কিংবা হার্ড কপি— মাধ্যমেও থেকেও কার্টুনে বেশ ইম্পর্ট্যান্ট হল তার কন্টেন্টটা কী। সেখানে সেরিব্রালটাই সবকিছু। আসলে ভার্চুয়ালি এই শিল্পটা করতে গেলে হাতে পেন-পেন্সিল নিয়ে ঘুরতে হয় না সবসময়। এটুকুই শুধু তফাৎ বলে মনে হয় আমার। তবে হাতে অনেকদিন কাজ না করলে, ডিজিটালে কাজ করাটা বেশ কঠিন।”
এক দশক আগেও শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকার প্রথম পাতা আলোকিত করে রাখত কার্টুন। অনেকেরই অভিযোগ, সেই ট্রেন্ড কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে সেখান থেকে দেখলে নতুন করে জন্ম নিচ্ছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কার্টুন। ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করেই কার্টুনকে নতুন করে প্রাণের স্পন্দন দিচ্ছেন ‘মালি’-র মতো শিল্পীরা। তবে একথা ঠিক তাতে কোনো স্থায়ী উপার্জন নেই। দু’-একটা ছোটো কাজের অর্ডার এলেও নিশ্চয়তা নেই কোনো। তবু শুধু শিল্পটাকে ভালোবেসে, নেশাটা আঁকড়ে ধরে রয়েছেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ার দায় কি একেবারেই নেই যে কোনো প্রকাশনা সংস্থার?
তবে এই বিষয়টিকে উল্টোভাবে দেখতেই পছন্দ করেন মালি, “ইন্ডিপেন্ডেন্ট কার্টুনের সুবিধা হল স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করা যেতে পারে। কোনো বড়ো মিডিয়া হাউসের হয়ে কাজ করাটায় সেক্ষেত্রে অনেক এডিট চলে আসে সামনে। সেটা দরকারও, এমন নয় যে সেটা উচিত না। তবে এখানে আমাকে বলার মতো কেউ নেই, যে এই বিষয়ে তুমি কার্টুন করো না বা এখানটা এভাবে বদলে যাও। তবে মাঝে মাঝে এটার মিসইউজ আমাকে ভাবায়। ধরো, আমি নিরপেক্ষভাবেই কোনো একটা কার্টুন আঁকলাম। সেটাকে বিরোধী পক্ষ তাঁদের প্রোপাগান্ডা হিসাবে ছড়িয়ে দিল।”
বিস্তৃতির প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন বিতর্কই বা বাকি থাকে কেন? এত জনপ্রিয়তা, হাজার হাজার লাইক-শেয়ারের পরেও কিছু মানুষের রোষের মুখে পড়তেই হয় যে-কোনো শিল্পীকে। সেটা যে কার্টুনের, কার্টুনিস্টেরই বৃহত্তর সাফল্য তা নিয়ে নতুন করে বলে দিয়ে হবে না। তবে এই বিতর্ক, কুরুচিকর মন্তব্যকে কীভাবে দেখেন তিনি? এই প্রশ্নই যেন ঘুরে চলে চিন্তার মধ্যে। মালি জানালেন, “প্রথম দিকে যখন গালাগালি আসত, মেসেজ আসত তখন গায়ে লাগত খুব। তারপর আমার এই অফিসেরই এক দাদা আমাকে বলল তুই নিশ্চয়ই সব দলের থেকেই এমন গালাগালি খাস। অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই সেখানে। তো সেই দাদাই আমাকে বলেছিল দু’দলের থেকেই যদি গালি খাস তাতে আর সমস্যা নেই। তাই এখন আর এগুলো নিয়ে ভাবি না।”
তবে শুধু ফেসবুকে কার্টুন প্রকাশের বাইরেও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্পকে নিয়ে। রাজারহাটে সদ্যনির্মিত কফি হাউসের দেওয়াল সেজেছে তাঁরই আঁকাতে। ঢুকে পড়েছে বাঙালির নস্টালজিয়ায়। তাছাড়াও সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটি কার্টুনের সংকলন। ‘মালি’স গ্যালারি’ নামাঙ্কিত সেই একশো পাতার বইতে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের কার্টুন। বাঙালি নস্টালজিয়া, কলকাতা, রাজনীতি— সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে সেখানে।
বর্তমান সময়ে ভারতে দাঁড়িয়ে শিল্পী-স্বাধীনতা প্রশ্নের সম্মুখীন। কোথাও কারাগারেও দিন কাটাতে হচ্ছে শিল্পীদের। এমন একটা প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও রাজনৈতিক এই ঘোলাজলকে সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এই চেষ্টা এক কথায় অনবদ্যই বলা চলে। কুর্নিশ জানাতে হয় সেই সাহসিকতাকেও। ফর্মের বদল হবে, বদলে যাবে কার্টুনের পরিপার্শ্বই। কিন্তু মালি’র মতো তরুণ শিল্পীদের হাত ধরেই যে নতুন এক যুগের সূচনা হতে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor