সাহিত্যিক নয়, ‘পাঠক’ হতে চেয়েছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী

‘লেখক’ সম্পর্কে সতীনাথ ভাদুড়ী (Satinath Bhaduri) লিখছেন, “বড় লেখক সে যে হতে পারবে না, তা সে জানে; কেন না খুঁটিনাটির উপর তাঁর এত ঝোঁক যে আসল জিনিসটাই যায় কলম এড়িয়ে।” ‘বড় লেখক’-এর সংজ্ঞা তাঁর কাছে কী ছিল জানা নেই। তবে কলম এড়িয়ে যাওয়া ‘আসল’ বস্তুগুলির সন্ধান মিলেছে তাঁর ‘জাগরী’, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর মতো উপন্যাসে। কিংবা ‘গণনায়ক’, ‘চকচকী’-র মতো গল্পে। ফলে তাঁর মুখে এই উক্তি বিনয় মনে হলেও, মানুষ হিসেবে এরকমই ছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। ডায়েরিতেও নিজের সঙ্গে অতিকথন করেননি। আত্মমগ্ন, প্রচারবিমুখ, স্বল্পভাষী—আবার একই সঙ্গে বন্ধুবৎসল, স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ কর্মী। 

সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্ম ১৯০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, বিহারের পূর্ণিয়ায়। পিতা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ছিলেন শহরের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। অত্যন্ত কড়া শাসনে কেটেছে ছোটোবেলা। এমনকী, স্নাতকোত্তর পাস করার পরেও শুধুমাত্র বাবার ইচ্ছেতেই পড়াশোনা করতে হয় আইন নিয়ে। অথচ মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনা ছিল ইংল্যান্ডে গিয়ে আইসিএস হওয়ার। আর সেই সময়েই নেমে আসে পরপর দুটি আঘাত। ১৯২৮ সালে মারা যান তাঁর মা রাজবালা দেবী ও দিদি করুণাময়ী। বাবার সঙ্গে দূরত্ব ছিল চিরকাল, আশ্রয় বলতে একমাত্র ছিলেন মা। সেই স্থান শূন্য হতে আরো অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন তিনি। কোনো অভিযোগ ছাড়াই নীরবে ফিরে আসেন আইন পাস করে। ওকালতিতে খ্যাতিও অর্জন করেন অল্প সময়ের মধ্যে। 

১৯৩৯ সালে আচমকা যোগ দিলেন কংগ্রেসে। ‘আচমকা’ শব্দটা ব্যবহার করা হল কারণ, এর পূর্বপ্রস্তুতি বিষয়ে সচেতন ছিলেন না কেউই। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেনুও টের পাননি কিছু। জীবন সম্পর্কে একপ্রকার ক্লান্তি সতীনাথকে তাড়া করে বেড়িয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। আইনব্যবসায় নেমে দেখেছেন দেশের প্রকৃত ছবি। সুযোগ বুঝে আদালতের লাইব্রেরিতে হাজারো বইয়ের মাঝে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজেকে। গান্ধীজির রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অবশেষে বেছে নেন আশ্রমের জীবনযাপন। ‘জাগরী’ উপন্যাসের নীলু-বিলুদের আশ্রমের বীজ লুকিয়েছিল তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যেই। একটা খাটো ধুতি, হাফ হাতা জামা আর চটি পরে নিয়োজিত হন সাধারণ মানুষের সেবায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, বহু যুগ পরে পেলেন মানসিক শান্তি, পেলেন সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য। জীবনের পাঠশালায় শুরু হল নতুন ক্লাস।

ভারতের রাজনীতির আকাশে তখন কালো মেঘের আনাগোনা অব্যাহত। দেরি হল না কালবৈশাখী শুরু হতে। গান্ধীজি-সুভাষচন্দ্র বিবাদ, বামপন্থী শক্তির উত্থানের মধ্যেই শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বহুমতের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও স্পষ্ট দেখা গেল বহুনীতির আগমন। সতীনাথ তখন পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের দায়িত্বে। ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের জন্য গ্রেপ্তারও হয়েছেন একাধিকবার। ‘ভাদুড়ীজী’ নামে তখন একডাকে তাঁকে চেনে পূর্ণিয়ার গ্রামগঞ্জের মানুষও। এভাবেই এসে পড়ল ১৯৪২। গান্ধীজি ডাক দিলেন ‘ভারত ছাড়’-র। হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, অথবা মৃত্যু—চঞ্চল হয়ে উঠল দেশবাসীর রক্ত। পুনরায় গ্রেপ্তার হলেন সতীনাথ। এবার দু’বছরের কারাদণ্ড। ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে ঠাঁই মিলল ‘নয়াগোল’ ওয়ার্ডে। জেলের ভিতরে কিছু রাজনৈতিক দায়িত্ব থাকলেও বাকি নিস্তরঙ্গ সময়টা কাটে একা। সবার সঙ্গে মেশেন ঠিকই, তবে কথা বলেন না বেশি। যেন স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে কী যেন লিখতে থাকেন একটা খাতায়।

আরও পড়ুন
লেখকের পরিচয় গোপন, উপন্যাসের নামেই নামকরণ কলকাতার রাস্তার

একদিন জেল সুপারকে গিয়ে অনুরোধ করলেন টি-সেলের ‘ডিগ্রি’তে তাঁকে রাখার জন্য। কী আশ্চর্য! বন্দি নিজে চাইছে নির্জন সেলে গিয়ে থাকতে। জোর করে কাউকে ওখানে পাঠানোর নিয়ম নেই, তবে স্বেচ্ছায় থাকতে চাইলে একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ওখানে বসেই শুরু হল তাঁর সাহিত্যসাধনা। ফণীশ্বরনাথও আসেন সেখানে প্রায়শই। সামনে একটা খাতা পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে ভেবেছিলেন ডায়েরি। নিজের মনেই শুরু করেন পড়া। অনুমতি ছাড়া অন্যের ডায়েরি পড়ছেন বুঝে কিছুটা লজ্জিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। শেষে সতীনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করে জানান, পড়া যখন শুরু করেই দিয়েছেন, তখন পড়ে ফেলুন বাকি অংশটুকুও। তবে বাকিদের সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না এ বিষয়ে। পুরো পাণ্ডুলিপিটা পড়ে ফেললেন তিনি। চোখে জল ভরে এল। কারাগারের অন্ধকূপে বসে সাক্ষী থাকলেন এক মহান সাহিত্যের জন্মকথার। সেই উপন্যাসের নাম ‘জাগরী’। আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এক পরিবারের সদস্যদের মনের কথা। রাজনীতি আর  পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহের অদ্ভুত ধারাভাষ্য। 

আরও পড়ুন
উপন্যাসের জন্য চাকরি খুইয়েছেন অজিত রায়, হতে হয়েছে ঘরছাড়াও

যদিও এই উপন্যাস প্রকাশ পাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছিল নানা সমস্যা। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) ও সজনীকান্ত দাসের একান্ত চেষ্টায় মুক্তি পায় ‘জাগরী’। ১৯৫০ সালে মেলে রবীন্দ্র পুরষ্কার। ততদিনে জন্ম হয়েছে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এরও। ছেড়েছেন কংগ্রেসের সঙ্গ। তারপরেও যে অনেক উপন্যাস-গল্প লিখেছেন তা নয়। কেন? উত্তর মিলতে পারে তাঁরই একটি উদ্ধৃতি থেকে,
“আমি ম’রে যাবার দেড়শ’ বছর পরে, আমার পোঁতা গাছ স্কুলের সৌন্দর্য বাড়াবে, এভাবে ভাবতে পারেন কজন শিক্ষক? জ্ঞান, সুরুচি, দূরদৃষ্টি, কর্তব্যনিষ্ঠা ছাড়াও, এর জন্য দরকার হয় আত্মবিলোপনের ক্ষমতার।”
সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্যই জনপ্রিয়তার সমুদ্রে ভেসে যাননি। সংখ্যায় অল্প লিখেছেন, কিন্তু সৌন্দর্য বাড়িয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ফুল গাছের। 

লেখক নয়, নিজেকে পাঠক মনে করতেন সতীনাথ ভাদুড়ী। বনফুলকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন সে-কথা। জীবন ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়ো পাঠশালা। বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত ভাষা তো বটেই, পরিচয় ছিল ফার্সি ও অন্যান্য কয়েকটি ভারতীয় ভাষার সঙ্গেও। ইউরোপের ইতিহাস জানবেন বলে শিখেছিলেন ফরাসি ভাষা। নিয়মিত চর্চা করতেন জার্মান ও রাশিয়ান। শুধুমাত্র পড়াশোনা করে যেতে পারলেই হয়তো খুশি হতেন, কিন্তু ‘দশচক্রে পড়ে’ হয়ে গেলেন সাহিত্যিক। তাঁর সমস্ত লেখক সত্তা আসলে জীবনের অভিজ্ঞতাগুলির ‘পাঠক’ সত্তার প্রতিফলনমাত্র।

Powered by Froala Editor

Latest News See More