১৯৩৩-৩৪ সাল। কলকাতার ব্রিটিশ টমটম গাড়ির শব্দ ভেদ করে তখন যেন একটু একটু করে শীতের সকালে জায়গা করে নিচ্ছে উইলো কাঠের উত্তাপ। সেই অদ্ভুত গন্ধে ম ম করে ওঠা ময়দান, জলা জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে খুঁটি দিয়ে আলাদা করে রাখা ফুটবল মাঠের কলকাতা। আর সেই জলা অঞ্চল থেকেই অধুনা রেড রোড তার চওড়া হাত মেলে চলে এসেছে ধূসর কল্লোলিনীর চকচকে মুকুট ইডেন গার্ডেন্সের দিকে। ইডেন তখন রোম্যান্টিসিজমের শেষ ঠিকানা। তার সবুজ গালিচায় সোনার মদিরা কবেই উপচে দিয়েছেন অজয় বসু!
তিরিশের দশক জুড়ে ইডেন দেখেছে কতকিছুই। সিকে নাইডুর অধিনায়কত্বে ১৯৩২-এ সেই প্রথম টেস্ট খেলার যোগ্যতা পেল ভারত। ইডেনে ১৯৩৪-এর ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন মহম্মদ নিসার, আমর সিং, জাহাঙ্গির খানেরা। এরপরে মুস্তাক আলির নামে পড়ে গেল পোস্টার। একটু একটু করে ফুটবলের উন্মাদনার ভেতরে অচিরেই কলকাতা জুড়ে শুরু হল ক্রিকেট উত্তাপ। তবু জাতীয় দল থেকে কিছুটা যেন ব্রাত্যই রয়ে গেলেন এক তরুণ, যার নামে ইডেনের বাইরে পড়া পোস্টারগুলো হারিয়ে গেল কালের নিয়মে, ১৩৮টা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে ৩৫৭ উইকেট আর ৩৭১৫ রান করেও যিনি সারাজীবনে খেললেন মাত্র একটা টেস্ট। রডনি রেডমন্ড কিংবা গোবো আশলের মতো এই বাঙালি তরুণও থেকে গেলেন ওয়ান টেস্ট ওয়ান্ডার হয়েই। তিনি বাংলার বিস্মৃতপ্রায় ক্রিকেটার সরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে সুঁটে ব্যানার্জি। খোকন সেনের পর দ্বিতীয় বাঙালি, যিনি ভারতীয় দলের ৫২ নম্বর টেস্ট ক্যাপটি পেয়েছিলেন...
তিরিশের দশকে কলকাতা শহরে এল ইংল্যান্ড দল। এম সি সি নামে তখন আনঅফিশিয়াল ম্যাচগুলি খেলতেন সাহেবরা। সেখানে ‘ইন্ডিয়ান্স এন্ড অ্যাংলোইন্ডিয়ানস বেঙ্গল’ টিমের হয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ডাক পেলেন সুঁটে ব্যানার্জি। এরপর সুঁটের ন্যাচারাল ইনসুইং-এর সৌজন্যে ১৯৩৫-৩৬ সালেই জ্যাক রাইডারের অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে বাংলা-আসামের যৌথ দলের হয়ে মাঠে নামলেন তিনি। জ্যাক রাইডারের অস্ট্রেলিয়া তখন ভারত সফরে এসেছিল ১৭টি ফার্স্ট ক্লাস ও ৪টি আনঅফিশিয়াল টেস্ট খেলতে। সে সময়ে টেস্ট খেলার মর্যাদা খুব কম দেশ লাভ করায় আনঅফিশিয়াল টেস্টের খুব রমরমা। এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ভেল্কি দেখালেন সুঁটে ব্যানার্জি। ৫৩ রানে ৫ উইকেট নিয়ে চমকে দিলেন সকলকে, আর এরই সৌজন্যে প্রথমবার ভারতের জাতীয় দলে ডাক এল তাঁর। খোকন সেন ভারতের প্রথম বাঙালি টেস্ট খেলোয়াড় হলেও ভারতীয় দলে প্রথম ডাক পাওয়া বাঙালি সম্ভবত সুঁটে ব্যানার্জিই।
‘একটুর জন্য কতকিছুই হল না যেন...’ - কেরিয়ারের চড়াই-এর সময়ে ডাক এলেও যেন সুঁটের কপাল খুলল না। ভারতের জাতীয় দলের পেস বোলিং-এ তখন মহম্মদ নিসার, অমর সিং, জাহাঙ্গির খানের ত্রিফলা - ফলে সুঁটের জায়গা হল না ব্রিটিশ মুলুকের তিনটি টেস্টের একটিতেও। কিন্তু দমলেন না সুঁটে, বিলেত থেকে ফিরেই ফের নেমে পড়লেন রঞ্জি মহড়ায়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা আশু প্রয়োজন। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেকের পর একমাত্র জ্যাক রাইডারের দলের বিরুদ্ধে আনঅফিশিয়াল টেস্ট খেলার জন্যেই কেরিয়ারের একমাত্র ফার্স্টক্লাস ম্যাচটি খেলতে পারেননি তিনি। নইলে ঘরোয়া ক্রিকেটে সুঁটের প্রভাব এতটাই ছিল যে বাংলার টিমলিস্টে সুঁটের নাম না রাখার দুঃসাহসও দেখাতেন না কেউ। সুব্রত গুহ এবং মুস্তাক আলিকে খেলানোর দাবিতে ইডেনে পোস্টার পড়ার অনেক আগেই সুঁটের নামে পড়েছিল পোস্টার। বাংলা আসাম ক্রিকেট বৃত্তে তখন উজ্জ্বল নাম এই বাঙালি অলরাউন্ডারের। ১৯৩৭-৩৮এর রঞ্জিতে সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার বিপক্ষে ৩৩ রানে ৫ উইকেট, হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে ৪৭ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলার পর ফাইনালে গুজরাট প্রভিন্সের জামনগর স্টেটের চাকরি নেবার জন্য আর খেলতে পারলেন না সুঁটে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই ভারত ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরূপে লর্ড টেনিসন একাদশের বিপক্ষে খেলার জন্যে আমন্ত্রিত হন তিনি। ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম খেলায় তিনি ৮৯ রানে ৬ উইকেট পান। তবে সুঁটের ক্রিকেট জীবনের সেরা বোলিং এসেছিল ১৯৪১ সালে। নভেম্বর মাস, মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে নয়ানগরের সদস্যরূপে এক ঘণ্টার অল্প সময় বেশি নিয়ে ২৫ রানে ৮ উইকেট পান ও উভয় ইনিংসেই দলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান তোলেন। পরের বছর জামশেদপুরে টাটা স্টিলে যোগদান করেন।
বাংলা অধ্যায় শেষ করে পাকাপাকি ভাবে বিহারের হয়ে খেলা শুরু করেন। খেলোয়াড় জীবনের বাকি ১৫ বছর বিহার দলের পক্ষে খেলেছিলেন তিনি।
১৯৪৯ সালে জামশেদপুরে প্রতিপক্ষ দিল্লি দল তৃতীয় দিনে ৪৬ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রসর হয়, হাতে তখন ৮ উইকেট। ব্যানার্জী হ্যাট্রিক করেন ও ঊনচল্লিশ মিনিটে গুটিয়ে দেন শক্তিশালী দিল্লিকে। ফলস্বরূপ কেরিয়ারের সায়াহ্নে আবার ভারতীয় দলে ডাক এল তাঁর। সে সময়ে নিসার-অমর-জাহাঙ্গিরের অবসরের ফলে জাতীয় দলে অভিষেক কার্যত নিশ্চিত ছিল তাঁর। তাছাড়াও পূর্বাঞ্চলের হয়ে ৩৭ বছর বয়সে দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে ৬ উইকেট নিয়ে হারিয়ে দেন সুঁটে ব্যানার্জি।
আরও পড়ুন
সচিনকেও টপকে গেলেন দ্রাবিড়, গত ৫০ বছরে দেশের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার তিনিই
‘নিশি শেষে তারার মতো’- তবু অপেক্ষার অবসান হতে লেগে গেল অনেকগুলো বছর। ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯। দেশ স্বাধীন হয়েছে সবে। মুম্বইয়ে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অবশেষে অভিষেক ঘটল তাঁর। জীবনের একমাত্র টেস্ট। ভারতের ৫২ নম্বর টেস্ট ক্যাপে লেখা হল সুঁটে ব্যানার্জির নাম। একমাত্র টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৫৩ রান দিইয়ে ১ উইকেট ও দ্বিতীয় ইংসে ৫৪ রান দিইয়ে ৪ উইকেট নেন তিনি। এর ফলে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। তবে আরেকটি রেকর্ডও এই সুযোগে পকেটস্থ করেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর তিনি প্রথম উইকেট তুলতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ৫টা বল। ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ইনিংসেও খুব দ্রুত চার উইকেট পান ও ভারতের জয়ের ৩৬১ রানের লক্ষ্যমাত্রায় নেমে তিনি মিডউইকেট দিয়ে হাঁকিয়েছিলেন এক বিশাল ছক্কা।
পরবর্তী তিন বছর ভারতীয় দল আর কোনো টেস্ট খেলেনি। স্বাভাবিকভাবেই পড়ন্ত সূর্য সুঁটে ব্যানার্জির ক্রিকেটজীবনও শেষ হয়ে গেল অচিরেই। সেই মিডউইকেটের উপরদিয়ে উড়ে যাওয়া লাল বল যেন চলে গেল সুঁটের জীবনের একমাত্র টেস্টের বহমান স্মারক হয়ে। থেকে গেল নামটুকু। বাংলার বুক থেকে কত ক্রিকেটারই তারপর পেলেন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ। নব্বই-এ সৌরভ গাঙ্গুলির উত্থানে বাংলার আনাচে-কানাচে আরও ছড়িয়ে পড়ল বাইশ গজের লড়াই-এর আঁচ। তবু শীতের ইডেন, সাদা জামার রোম্যান্টিসিজম, পোস্টকার্ডের হলদে তিলোত্তমার বুকে একটা ৫২ নম্বর টেস্ট ক্যাপ পড়ে থাকল অনেক অভিমান নিয়ে। প্রায় ৯০ বছর পর সে স্মৃতির ধুলো মাখা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি আমরা?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জাতীয় দলের ১০ জন ক্রিকেটারের শরীরে করোনা, সংকটে পাকিস্তান