সাল ১৯২৯। তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক ‘মডার্ন রিভিউ’-এর একটি খবর চোখ টানল আপামর ভারতের। ঘটনার মূল মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ। মিরাট কলেজের দর্শন বিভাগের তরুণ অধ্যাপক যদুনাথ সিনহা গুরুতর একটি অভিযোগ সামনে এনেছেন সেখানে। তাঁরই ডক্টরেটের থিসিস থেকে বেশ কিছু অংশ হুবহু ‘নকল’ করে নিজের বই প্রকাশ করেছেন এক স্বনামধন্য ব্যক্তি। ঘটনাচক্রে যদুনাথবাবু সেই মানুষটির ছাত্রও ছিলেন একটা সময়। নিজের শিক্ষকের এমন আচরণ স্তব্ধ করে দিয়েছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে প্রকাশ পায় সেই খবর। কে ছিলেন সেই স্বনামধন্য ব্যক্তি? অবাক লাগলেও, নামটি অনেককেই স্তম্ভিত করে দেয়। তিনি ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন!
তাঁর জন্মদিন গোটা দেশ বিশেষভাবে উদযাপন করে। তিনি স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি; ভারতরত্নও বটে। শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, আরও কত সত্তা হাজির হয় তাঁর নামের পাশে। আর সেই সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গেই কিনা জুড়ে আছে এমন বিতর্ক! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অবাক লাগাটা স্বাভাবিক। সেদিনও সবাই অবাক হয়েছিলেন। তাঁর মতো শিক্ষাবিদ সত্যিই কি এমনটা করেছিলেন? কিন্তু যদুনাথ সিনহাও নাছোড়বান্দা। তিনি নিজেও পরবর্তীকালে অন্যতম নামী শিক্ষাবিদ হয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার তাঁর দখলে। ১৯২৯ সালে কী এমন হল তাহলে, যাতে ঝড় বয়ে গেল দেশে?
১৯২৫ সালে নিজের পিএইচডি’র থিসিস হিসেবে যদুনাথ সিনহা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। নাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান সাইকোলজি অফ পারসেপশন’। প্রসঙ্গত এই গবেষণাপত্রটির দুটি ভলিউম এর আগেই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। প্রথমটি ১৯২২ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯২৩-এ। পুরো বিষয়টা শেষ হয় ১৯২৫-এ। এই গবেষণার জন্য যদুনাথ গ্রিফিথ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌয়াট মেডেলও লাভ করেন।
ইতিমধ্যেই ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কিং জর্জ ফাইভ চেয়ার অফ মেন্টাল অ্যান্ড মোরাল সায়েন্স’ পদে নির্বাচিত হন ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন। মনে রাখা দরকার, সেই সময় দাঁড়িয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশেষ পদটি ছিল দর্শনশাস্ত্রের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ও সম্মানজনক চেয়ার। যদুনাথ সিনহার সেই গবেষণাপত্রটি তিনি সেখানেই পড়েন। এরপরই মিরাট কলেজে অধ্যায়নের জন্য চলে যান যদুনাথ; আর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন নিজের বই তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’ বিশ দশকের শেষের দিকে বের হয়। মোট দুটি ভলিউমে দেখার চেষ্টা করেন ভারত ভূখণ্ডের দর্শনচিত্রকে।
এখানেই হয় বিপদ। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রীতিমতো বোমা ফাটান যদুনাথ সিনহা। বক্তব্য, তাঁর প্রকাশ করা ডক্টরেট থিসিস থেকে রীতিমতো ‘নকল’ করেছেন ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন! অভিযোগ মূলত ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’-এর দ্বিতীয় ভলিউম নিয়ে। সেখানেই নাকি এমন কাণ্ডটি করেছেন রাধাকৃষ্ণন! তিনি কপিরাইট নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। শুধু জানুয়ারি নয়; ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল— তিন মাস ধরে এই খবর প্রকাশ করা হল মডার্ন রিভিউয়ে। বিষয়টা গড়াল আদালত পর্যন্ত। ওই বছরেরই আগস্টে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করলেন যদুনাথ সিনহা। বিপক্ষে ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন…
অপর পক্ষও চুপ করে থাকেননি। রাধাকৃষ্ণন দাবি করেন, ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’র পাণ্ডুলিপি তিনি ১৯২৪ সালেই দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশক ছাপতে দেরি করায় তিন বছর পিছিয়ে যায়। তারিখ এই গোটা মামলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ভেতরে যখন এসব চলছে, বাইরে তখন ঝড়। এত বড়ো খবর, দূরে থাকা যায় নাকি! স্বনামধন্য শিক্ষক বনাম ছাত্র, আর একটি ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব মিলিয়ে জনসাধারণের উৎসাহ ছিলই। চরিত্র হানি করার চেষ্টা চলছে— এই মর্মে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনও এক লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। অভিযোগের তির যদুনাথ সিনহা এবং মডার্ন রিভিউয়ের সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন
শুধুমাত্র গল্প-বলিয়ে হয়েই থেকে গেলেন তপন সিংহ, শিক্ষকের স্থান দিল না বাঙালি
এই ঘটনার অন্য একটা দিকও খুঁজে পান অনেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমন গুরুত্বপূর্ণ পদে কোনো বাঙালিকে না নিয়ে নেওয়া হল একজন দক্ষিণ ভারতীয়কে। ফলে আগে থেকেই কলকাতার শিক্ষিত সমাজের একটা অংশের উপেক্ষার শিকার হয়েছিলেন ডঃ রাধাকৃষ্ণন। এই মডার্ন রিভিউ পত্রিকাতেই তাঁকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করা হত। কাজেই এরকম একটা ইস্যু পেয়ে যাওয়ার পর সেই ঝাঁজটা আরও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। যেহেতু মূল সমস্যার মঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়, তাই সেখানেই মিটিয়ে নেওয়া হোক সবটা। এর থেকে বেশি দূর এগোলে সবারই সমস্যা। শেষমেশ ১৯৩৩ সালের মে মাসে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। দুই পক্ষই নিজের নিজের দাবি তুলে নেয়। আসল সত্যি যে কী ছিল, সেটা নিয়ে কেউই উচ্চবাচ্য করেননি আর।
Powered by Froala Editor