শরৎচন্দ্র ডাকতেন ‘গণিত-শিল্পী’ নামে, তাঁর অনুরোধেই বই লিখলেন কে সি নাগ

সময়টা তিরিশের দশকের একেবারে গোড়ার দিক। কলকাতায় তখন সজনীকান্ত গড়ে তুলছেন কল্লোল যুগের সাহিত্যিকদের আড্ডা। তবে সেটা ছাড়াও সাহিত্যিকদের নানা আড্ডা বসত এই শহরে। তেমনই একটি সভা ছিল কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িতে 'রসচক্র সাহিত্য সংসদ'। তবে সেখানে সদস্যরা একটু প্রাচীনপন্থী। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের নামই তখন ছাপার অক্ষরে পাঠকদের কাছে পরিচিত। কেবল একজন নন। তিনি কবিশেখরের মিত্র ইনস্টিটিউটের সহকর্মী কেশবচন্দ্র নাগ। তিনি গণিতের শিক্ষক। কিন্তু আড্ডার একটি সদস্যের নাম ছাপার অক্ষরে চিনবেন না কেউ, তা কি হয়?

বোধহয় এমন কোনো তাড়না থেকেই কেশবচন্দ্রকে বই লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকেন কবিশেখর। কিন্তু কী লিখবেন কেশবচন্দ্র? উত্তর দিলেন কালিদাস নিজেই। "ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় যে ভাই তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?" এর আগে অবশ্য কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের অনুরোধ একাধিকবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকের সমবেত চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত হার মানলেন কেশবচন্দ্র। ভাগ্যিস হার মেনেছিলেন। আর তাই ১৯৩২ সালে ইউ. এন. ধর অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম বই 'নব পাটীগণিত'।

এতক্ষণে নিশ্চই বুঝে গিয়েছেন এই কেশবচন্দ্র নাগই আমাদের চিরকালের পরিচিত কে সি নাগ। সেই তেলমাখা বাঁশ আর বাঁদরের ওঠানামা, অথবা চৌবাচ্চায় জল একদিক দিয়ে ঢুকছে আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এইসব অঙ্ক দিয়েই তো তৈরি আমাদের প্রত্যেকের ছেলেবেলা। কারোর কাছে সেসব স্মৃতি এখনও মূর্তিমান আতঙ্ক, আবার কেউ এখনও সময় পেলেই একটু মস্তিষ্কের ব্যায়াম করতে বসে যান। কিন্তু কেসি নাগের বই কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেননি, এমন বাঙালি অবশ্য পাওয়া যাবে না।

কিন্তু এইসব অঙ্কের আড়ালে প্রকৃত মানুষটি কে? বইয়ের শুরুতে তো কিছুই লেখা নেই। এমনকি লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্মারক কোনো ডিগ্রিও নেই। স্বভাবলাজুক মানুষটি ইচ্ছা করেই সেসব লেখেননি। কিন্তু তাবলে যে কিছু জানা যাবে না, তাই কি হয়? তিনি নিজে না লিখলেও অন্যরা লিখেছেন। আর সেখান থেকেই জানা যায়, ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করলেন কেশবচন্দ্র নাগ। তবে শৈশবেই মারা গেলেন বাবা রঘুনাথ। মা ক্ষীরদাসুন্দরী কোনোরকমে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে থাকেন। আর ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনোর প্রতি কেশবচন্দ্রের আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রথমে এলাকার একটি স্কুলে, আর তারপর ভাস্তারা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা। এরপর কিষেনগঞ্জ হাইস্কুল। ১৯১২ সালে ভর্তি হলেন রিপন কলেজে। সেখান থেকেই ১৯১৪ সালে পাশ করলেন আইএসসি। সংসারের জোয়াল তাঁর কাঁধের উপর। শিক্ষকতা শুরু করলেন ভাস্তারা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে। তবে সেইসঙ্গে চালিয়ে গেলেন পড়াশুনো। অঙ্ক এবং সংস্কৃত নিয়ে স্নাতক পাশ করে শিক্ষকতা শুরু করলেন কিষেনগঞ্জ হাই স্কুলে। তারপর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল।

এই সময়েই তাঁর শিক্ষকতার প্রতিভা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। জানতে পারলেন বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজেও। তিনিই কেশবচন্দ্রকে নিয়ে এলেন মিত্র ইনস্টিটিউটে। আর তার পরের ঘটনার কথা আগেই বলেছি। তবে প্রথম বই তো বেরোল। কিন্তু এরপর? এরপর একদিন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল তাঁর বাড়িতে এসে একটি বাঁধানো খাতা দেখতে পেলেন। তাতে নানা জটিল অঙ্কের সমাধানের সূত্র লেখা। প্রকাশক তৎক্ষণাৎ বায়না ধরলেন এই খাতা প্রকাশ করার। কিন্তু কেশবচন্দ্র রাজি নন। অঙ্কের আবার গাইডবুক হয় নাকি? হ্যাঁ, সেই প্রথম বাংলা ভাষায় অঙ্কের গাইডবুক প্রকাশিত হল। 'ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স', প্রকাশের সাল ১৯৪২।

এরপর সারা জীবনে ৪২টি বই লিখেছেন তিনি। সেইসঙ্গে অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখা। যোগ দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামেও। নিজেই একসময় তৈরি করলেন প্রকাশনী। আর অন্য যে বিষয়টা চিরকাল তাঁর সঙ্গী হয়ে ছিল, সেটা ফুটবল। আমৃত্যু মোহনবাগানী কেশবচন্দ্র অবশ্য শেষ পর্যন্ত খেলার মাঠে যেতে পারতেন না। খেলার সম্প্রচার শুনতেন রেডিওতে। আর তখন পাটিগণিত ছেড়ে ধরা দিত জ্যামিতি। ছবি এঁকে পাশের মানুষদের বোঝাতেন, বলের অবস্থান ঠিক কোথায়। ঠিক এমনিভাবে একদিন শুনছিলেন সম্প্রচার। তবে ফুটবল নয়। চলছিল কানপুরের ভারত-পাক টেস্ট ক্রিকেট। দিনটা ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫। টানটান উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ সংজ্ঞা হারালেন তিনি। সেরিব্রাল স্ট্রোক। এরপর দুবছর কোনোক্রমে বেঁচে ছিলেন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আর উঠতে পারলেন না। ১৯৮৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেমে গেল সব অঙ্ক কষা।

আরও পড়ুন
বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু, নীরবেই চলে গেলেন বিস্কফার্মের কর্ণধার কৃষ্ণদাস পাল

না, থেমে একেবারে যায়নি। আজও তেল মাখা বাঁশে বাঁদর ওঠে, চৌবাচ্চার জল একদিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিকে বেরিয়ে যায়। চতুর্থ থেকে দ্বাদশ সমস্ত শ্রেণীর পড়ুয়াই এখনও কে সি নাগের বইতে হাত রাখেন। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন কোনো বইয়ের দোকান থেকে কে সি নাগের বই বিক্রি হয় না। তবে এখন নতুন সিলেবাসের যে বইগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর উপর সেভাবে ভরসা রাখতে রাজি নন শিক্ষকরা। কিন্তু যেসব পড়ুয়া মন দিয়ে অঙ্ক শিখতে চায়, তারা এখনও খুঁজে বের করে কেসি নাগের লেখা আসল বই। যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি একদিন পরম যত্নে তৈরি করেছিলেন কেসি নাগ। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র যাঁর নাম রেখেছিলেন গণিত-শিল্পী।

তথ্যসূত্রঃ কে সি নাগ, সুস্নাত চৌধুরী, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
১৯৩৮-এ পথ চলা শুরু, ৮২ বছর পেরিয়ে লকডাউনেই সর্বোচ্চ ব্যবসা পার্লে-জির