তাজমহলের দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি তাঁরই; পাঞ্জাবের গ্রামে ধুঁকছে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর শেষ চিহ্ন

পাঞ্জাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর অমৃতসর থেকে যদি ক্রমশ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোন, তাহলে বেশ কয়েক কিলোমিটার পেরোলেই পৌঁছে যাবেন অন্য একটি জেলায়। নাম, তারন তারান। সেখানে পৌঁছে তারন তারান-আটারি রোডের খোঁজ করতে শুরু করলেন। সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই দেখা মিলবে একটি বিশাল বড়ো গেট। আর গেটের ওপারেই যেন এক ভগ্ন সাম্রাজ্য। লাল ইটের স্থাপত্যগুলো আর আগের অবস্থায় নেই। কিন্তু এককালে যে এখানেই এসে হাজির হয়েছিল ইতিহাস, তা গঠন দেখলেই বোঝা যায়। যদি বলা হয়, এই ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মুঘল রাজবংশ, শাহজাহান এবং সর্বোপরি— তাঁর সাধের তাজমহল? ম্যাপ আপনাকে বলে দেবে জায়গাটির নাম, ‘সরাই আমানত খান’। কিন্তু ভেতরের কথাগুলো শুনতে হলে একবার হাত ছুঁয়ে দেখতে হবে এই অদ্ভুত ইতিহাসকে…

বলে নেওয়া ভালো, একটা সময় এই সরাইয়ের পাশ দিয়েই চলে গিয়েছিল ওল্ড লাহোর-আগ্রা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। আজ অবশ্য রাস্তাটি ‘নেই’ হয়েই আছে। কিন্তু ইতিহাসকে কি এত সহজে দমিয়ে রাখা যায়? শুরু করা যাক আমানত খান সিরাজি’কে দিয়ে। মুঘল আমলে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অক্ষরশিল্পী বা ক্যালিগ্রাফার ছিলেন তিনি। তাজমহলে ঘুরতে গেলে সৌধের গায়ে যে কোরানের ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়, তা এঁরই সৃষ্টি। সুন্দরের প্রতীক যেন আরও রূপ খুলেছিল তাঁর দৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু এই ভারত আমানত খানের জন্মস্থান ছিল না। ঐতিহাসিকরা বলেন, সুদূর ইরানে জন্মেছিলেন আমানত, সেখানেই বেড়ে ওঠা তাঁর। তখন অবশ্য তাঁর নাম ছিল আবদ-আল হক। সেখান থেকে শুরু হয় এক ইতিহাসের যাত্রা… 

ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ ছিল আবদ-আল হকের। ছোটো বয়স থেকেই ক্যালিগ্রাফির কাজ নিয়ে তাঁর ওঠাবসা। হাতের নিপুণ টানে ক্রমশ জীবন্ত হয়ে ওঠে অক্ষরগুলো; সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কাজে ফুটে ওঠে সৌন্দর্য। বড়ো দাদা আফজল খান, ভাইয়ের এই ক্ষমতাকে হারিয়ে যেতে দেননি। তাই যখন ভারতে মুঘল রাজদরবারের উদ্দেশ্যে যখন পাড়ি দিলেন, তখন সঙ্গে নিলেন আবদ-আল হককেও। দুজনে মিলে সতেরশো শতকের শুরুর দিকে এলেন আগ্রা। মসনদে তখন শাহজাহান। আবদ-আল তাঁর ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে কাজ করতে শুরু করলেন। 

দাদা আফজল খানও কম ছিলেন না। তাঁর বুদ্ধি, বিচার ক্ষমতা এবং সরকারি কাজে দক্ষতা— এই সমস্ত কিছু শাহজাহানের চোখে পড়তে খুব সময় নেয়নি। ফলে একটা সময় পর তিনি হয়ে যান মুঘল রাজদরবারের অন্যতম ‘ভিজির’ বা প্রধানমন্ত্রী। আবদ-আল হকের ক্যালিগ্রাফি দক্ষতা যে শিল্পপ্রিয় শাহজাহানের নজর এড়াবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। সিকান্দ্রায় সম্রাট আকবরের সৌধের বাইরে যে বড়ো গেটওয়ে আছে, সেখানে তিনিই কোরানের ক্যালিগ্রাফি কাজ করেছিলেন। এইভাবেই চলছিল; হঠাৎ ঘটে গেল বিপর্যয়। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান শাহজাহানের প্রিয়তমা বেগম মুমতাজ। শোকে কাতর সম্রাট ঠিক করলেন, বেগম সাহেবার স্মৃতিকে ধরে রাখবেন তিনি। এমন ইমারত তৈরি করবেন, যা পৃথিবীর বুকে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যাবে। মুমতাজ অমরত্ব পাবেন; সঙ্গে শাহজাহানও। আগ্রায় তৈরি হওয়া শুরু হল শ্বেতপাথরের মর্মর সৌধের। চোখের সামনে একটু একটু করে বেড়ে উঠল তাজমহল… 

শুধু সৌধ নির্মাণ করলেই তো হবে না; ভেতরের দেওয়ালে একটু আঁকিবুঁকিও তো দরকার। শাহজাহানের নির্দেশ, সবটা যেন সুন্দর হয়। সেই সময় দাঁড়িয়ে আবদ-আল হকের থেকে ভালো ক্যালিগ্রাফার আর ছিল না। কাজেই তাঁর কাছে নির্দেশ গেল। ১৬৩২ থেকে ১৬৩৮— ছয় বছর ধরে তাজমহলের গায়ে নিজের তুলি চালালেন তিনি। কোরানের গাথায় ভরে গেল সৌধ। শিল্প ফুটে উঠল প্রতিটা অক্ষরে। শাহজাহান মুগ্ধ হলেন এমন কাজ দেখে। আবদ-আল হককে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। সেইসঙ্গে নতুন একটি উপাধি দিলেন— ‘আমানত খান’; তাঁকে মনসব পদে উন্নীত করলেন। ভরিয়ে দিলেন ধন দৌলতে। আবদ-আল হক অতীত; জন্ম নিল আমানত খান নামের এক কিংবদন্তি। 

তাজমহল তো শেষ হল। কিন্তু এবার আমানত খানের পরিবারে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে, সেটা কে জানত! যে দাদার হাত ধরে ইরান থেকে আগ্রার দরবারে হাজির হয়েছিলেন তিনি, সেই দাদা, আফজল খান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমানত খান যেন চোখে অন্ধকার দেখলেন। তাঁর প্রিয় দাদা, তাঁর শ্রদ্ধার মানুষটি আর নেই! তিনি যে কেবল মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাই নয়, সারাজীবন শিখিয়েছেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। মানুষের কথা ভাবতে। আমানত খান তড়িঘড়ি চলে গেলেন লাহোর। আফজল খানের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র শাহজাহান নির্দেশ দিলেন, তাঁর মরদেহ যেন আগ্রায় নিয়ে আসা হয়। যমুনার ধারে, মক্কার দিকে মুখ করে তৈরি হল সৌধ। আজও যা ‘চিনি কা রউজা’ নামে পরিচিত। 

আরও পড়ুন
ঝড়ের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত তাজমহল, ভেঙে পড়ল মার্বেল ও রেলিং

আর আমানত খান? সেই যে আগ্রা ছাড়লেন, আর এলেন না। মন বসছে না আর কিছুতে। বড়ো, সুন্দর রাজকীয় সৌধ নির্মাণ করাই কি একমাত্র কাজ? তাঁর দাদা কি এটাই চাইতেন শুধু? এই চিন্তা থেকেই মাথায় এল সরাইখানা তৈরি করার কথা, যাতে সমস্ত মানুষ উপকৃত হয়। তাজমহল তৈরির পরই লেগে পড়লেন জীবনের শেষ বড়ো কাজে। উপার্জিত সমস্ত অর্থ লাগিয়ে দিলেন এতে। এও তো এক ভালোবাসার কাহিনি! ভালোবাসার যে অনেক নাম… 

ওল্ড গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড সেইদিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। লাহোর শহরের বাইরে সেই রাস্তারই লাহোর-আগ্রা অংশের পাশে তৈরি করতে লাগলেন এই সরাইখানা। নাম দিলেন ‘সরাই আমানত খান’। দুদিকে দুটো গেট; দিল্লি গেট এবং লাহোরি গেট। দুই প্রবেশপথ তো বটেই, সেইসঙ্গে সরাইখানার ভেতরের বাড়ি ও স্থাপত্যগুলি ভরিয়ে দিলেন ক্যালিগ্রাফিতে। ভেতরে ঢুকলে রাস্তার দুইধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বাড়ি। সেগুলোই সরাইখানা। সমস্ত রকম মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এটি। কাপড় কাচার জায়গা, রান্নাঘর, লন, বিশ্রামাগার— সব মিলিয়ে ভরপুর আয়োজন। কোথাও কোনো ত্রুটি রাখতে চাননি আমানত খান। এমনকি পশুদের জন্যও ছিল থাকার জায়গা। আর ছিল অজস্র কুয়ো। লাহোরি গেটের ছবি দেখলে দেখা যায়, গেটের বাইরেই আছে একটি ‘বাওলি’ অর্থাৎ কুয়ো। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সেটি সম্ভবত খোঁড়া হয়েছিল স্থানীয় মানুষদের জন্য। 

সমস্ত কিছু তৈরি হওয়ার পর ভগবানের আরাধনা করেই কাটিয়ে দেন আমানত খান। এই সরাইখানার ভেতরেই শেষ শয্যায় শায়িত আছেন তিনি। কিন্তু সরাই আমানত খানের বর্তমান অবস্থা দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। মূল অংশটি ভারতের পাঞ্জাবের মধ্যেই রয়েছে। সেখানে গেলে ভগ্নস্তূপ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। গোটা সরাইখানা জুড়ে যে ক্যালিগ্রাফি এঁকেছিলেন আমানত খান, তার কিছু অংশই লেগে আছে দেওয়ালে। কিছু অংশ সংরক্ষণ করে রাখা আছে মিউজিয়ামে। বাকিটা শুধুই সময়ের ক্ষতচিহ্ন। আমানত খানের শেষ চিহ্নটুকু যত্ন করে রাখার প্রয়োজন কি অনুভব করেনি প্রশাসন? প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে, অনেকবার। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। স্থানীয় মানুষদের কল্যাণেই একটু একটু করে বাইরের মানুষজন জানতে পারেন। তাঁরা আসেন, ঘুরে দেখেন, তারপর ফিরে যান। ইতিহাস এভাবেই হয়ত টিকে থাকবে আরও বহু বছর। কে জানে, হয়ত বিলীনও হয়ে যেতে পারে… 

আরও পড়ুন
তাজমহলের থেকেও বিখ্যাত এই বস্তি, ভারতে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে দরিদ্র পর্যটন

তথ্যঋণ - 

Sarai Amanat Khan: Legacy of the Taj Calligrapher/Aashish Kochhar, Live History India

Sarai Amanat Khan, onefivenine.com

আরও পড়ুন
তাজমহল গড়েননি, আস্ত এক গ্রামকে সবুজ করে তুলেছেন এই শাহজাহান

Powered by Froala Editor