সখা ক্রিকেট কাহারে কয়? ধূ ধূ মাঠের ওপর পড়ে থাকা তিনটে উইকেট, ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকা উপবৃত্তাকার সবুজে সন্ধে। নামার মুখে এ প্রশ্ন করলে প্রতিধ্বনি আসে- 'ধর্ম'- ধর্ম বা ধারণ করার এই যে বিশাল পরিসর, উপমহাদেশীয় জলহাওয়ায় তার মসীহা হল ক্রিকেট। বিলিতের উইলোকাঠের বিনোদন ১৪০ বছর ধরে ক্রমেই হয়ে উঠল উপমহাদেশের হৃদস্পন্দন। সেই জেন্টলম্যানস গেমের পুরোধা ডব্লু জি গ্রেসের মতোই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলেন ক্রিকেটের এক প্রাণপুরুষ। একটু একটু করে ঔপনিবেশিক ভারতের পূর্বপ্রান্তে ক্রিকেটকে তিনি ছড়িয়ে দিলেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ১৮৮০ সাল, ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণময় টেস্ট সিরিজ দ্যা আসেজ শুরু হচ্ছে ব্রিটিশ মক্কায়, এদিকে কিশোরগঞ্জের এক যুবক ব্রিটিশ শাসনের অন্তরালে শানিয়ে নিচ্ছেন এক অস্ত্র, ক্রিকেট, একটা অদ্ভুত নেশার মতো তিনি বাংলার মাটিতে ক্রিকেটকে পরিচয় করাচ্ছেন হাত ধরে। তিনি শ্রী সারদারঞ্জন রায়। বাংলা ক্রিকেটের ডব্লু জি গ্রেস। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় দাদা সারদারঞ্জন ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ সদর হয়ে ঢাকা অবধি। পরবর্তীকালে শতবছরের আভরণে সেজে যে ক্রিকেটই হয়ে উঠল ভারতের বিনোদনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত জিয়নকাঠি।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে বাংলা তথা পূর্বভারতের মানুষের মনে এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে নিয়মিত ব্যায়াম-কুস্তির পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক খেলাকে নিয়ে আসা। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ফুটবল খেলাটা শুরু করার সময় থেকেই ক্রিকেটের ও চল শুরু হয় বাংলায়। তবে বাংলা বলতে কিন্তু অবিভক্ত বাংলার কথাই বলা যেতে পারে। ব্রিটিশ সেনার বিনোদনের জন্য আয়োজিত ক্রিকেটে অংশ নেওয়া শুরু করলেন মহারাজারা৷ মহারাজা ও মধ্যবিত্ত বাঙালির ক্রিকেট নিয়ে যে উৎসাহ শুরু হয়েছিল, তা আরও বাড়ল উত্তরবঙ্গে ব্রিটিশদের সঙ্গে আয়োজিত ক্রিকেট ম্যাচে মহারাজাদের দল হিসেবে অংশ নেওয়ার পর। তবে তা নিতান্তই সমাজের এক নির্দিষ্ট স্তর অবধি সীমাবদ্ধ ছিল। এই ক্রিকেটের স্ফুলিঙ্গকেই দিকে দিকে ছড়িয়েছিলেন সারদারঞ্জন।
কিশোরগঞ্জের কাটিয়াদি গ্রামে জন্ম সারদারঞ্জনের। বিখ্যাত রায় পরিবারে তখন একে একে আসছেন ঊপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলুদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন। সে সময়ে কিশোরগঞ্জ ছিল ময়মনসিংহের অংশ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিত্তবান ও বিস্তৃত অংশ ছিল এই ময়মনসিংহ। তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল,নেত্রকোণা ইত্যাদি অঞ্চলে ভাগ করা ছিল। স্কুল জীবন শেষ করে ঢাকাতে এসে বিখ্যাত ঢাকা কলেজে ভর্তি হন রায় পরিবারের পাঁচ ভাই। সারদারঞ্জনের ক্রিকেট প্রেম শুরু স্কুলজীবন থেকে। কাটিয়াদি গ্রামের রাস্তা দিয়ে পাঠশালা যাবার সময় একহাতে বই আর একহাতে ব্যাট থাকত তার। তবে আধুনিক ক্রিকেট ব্যাটের যে গঠন তা তখনও সম্পূর্ণভাবে আবিস্কার হয়নি, ঐ ছোট্ট সারদারঞ্জনই পরবর্তীকালে যে এই উইলোকাঠের ব্রহ্মাস্ত্রের আধুনিক গঠন দেবেন কেই বা জানত তখন?
ঢাকা কলেজে পড়াকালীন ক্রিকেটের প্রতি প্রবল টান থেকেই চারভাই-এর সহায়তায় সারদারঞ্জন খুলে ফেলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। সারদা নিজের দুরন্ত একাডেমিক কেরিয়ারের পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা চালাতেন পুরোদমে। এই ক্লাবে আগত পড়ুয়াদের শেখানো হত ক্রিকেটের ব্যকরণ, পাশ্চাত্য ক্রিকেটের গল্প। বিলিতি খেলার গল্পে মজে এবং ক্রিকেটের নিজস্ব সৌন্দর্যে প্রভাবিত হল একটা প্রজন্ম। সেই ঐতিহাসিক ঢাকা কলেজে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করল ক্রিকেট।
আরও পড়ুন
ভোট - ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অধিকাংশ খেলায় পশ্চিমবঙ্গ কি পিছিয়ে রয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
সারদারঞ্জন জানতেন, ঊনিশ শতকে মধ্য ও পশ্চিম ভারতীয়দের ধারণা ছিল দৈহিক সক্ষমতায় বাঙালিরা কখনোই তাঁদের সমতুল্য নয়। ক্রিকেটের প্রয়োজনে সারদা এই মিথকে ভেঙে ক্রিকেটের পাশাপাশি শরীরচর্চার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন ঢাকা ক্লাবে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল ঢাকা ক্লাব ক্রিকেট টিম। বাংলার ক্রিকেট প্রজন্মের সম্ভবত প্রথম বাঙালি যুব ক্রিকেট দল। স্নাতক পাশ করার পর সারদারঞ্জন যুক্ত হলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক হিসেবে। অঙ্কের পাশাপাশি আলিগড়েও তিনি গড়ে তুললেন ক্রিকেটের আবহ। কয়েক বছর অধ্যাপনার পর তিনি ফিরে এলেন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাবের জনপ্রিয়তা তখন ঊর্দ্ধমুখী। সেই অবস্থাতেই প্রথম ক্রিকেটের প্রতিযোগিতামূলক খেলার জন্য প্রস্তুতি শুরু করল ঢাকা কলেজ টিম। ১৮৮৪ সালে ইডেন গার্ডেন্সের ঐতিহাসিক প্রাঙ্গনে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের মুখোমুখি হল ঢাকা কলেজ। এই ম্যাচে জয়লাভও করল তারা। এর ফল হল বেশ মজার৷ প্রেসিডেন্সি এই হার সহজে মেনে নিল না। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের দলে সারদা-প্রমদা-কুলুদা তিন অভিজ্ঞ অধ্যাপকের নাম থাকায় তারা বিক্ষোভ জানায়৷ সারদারঞ্জনের ক্রিকেটীয় স্কিল ছিল ঈর্ষণীয়।
আরও পড়ুন
৮ বছর বয়সে হাত খুইয়েও ছাড়েননি খেলা, রাজ্যের অধিনায়কও হয়েছেন এই ক্রিকেটার
এই বিক্ষোভের পর প্রেসিডেন্সি কলেজের ব্রিটিশ অধ্যাপক ও ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের যৌথ পিটিশনে ঢাকা কলেজের ক্রিকেট টিম থেকে নাম বাদ দিতে বাধ্য করা হল শিক্ষকদের। দল থেকে বাদ পড়লেন প্রতিষ্ঠাতা সারদারঞ্জন ও তাঁর দুই ভাই। এই রাগে সারদারঞ্জন ঢাকা কলেজ ত্যাগ করলেন সেই বছর। তবে একথা ঠিক, বাগবিতণ্ডা থাকলেও ক্রিকেটের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই সারাবাংলায় জনপ্রিয় করেছিল ক্রিকেটকে।
আরও পড়ুন
খেলার দুনিয়ায় যা যা ‘শিরোনাম’ হয়ে উঠল এই বছর
তবে ক্রিকেট নিয়ে সারদারঞ্জনের ভালবাসা সেই সময়ের সমাজে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি মজার ঘটনায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন কলকাতার মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশানের সর্বাধিপতি। তিনি সারদাকে অনুরোধ করেন সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য। কিন্তু সে সময়ে মেট্রোপলিটানে চলছিল ব্যাপক অর্থসংকট। কলকাতায় ক্রমবর্ধমান ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে সারদারঞ্জন 'S Ray and Company' নামের একটি সংস্থা খুলে বই ও ক্রিকেট সরঞ্জাম বিক্রি করতে শুরু করলেন। ১৮৯৫ সালে এই কলকাতা শহরে সারদারঞ্জন প্রথম ক্রিকেট সরঞ্জাম বিপণীর দোকান ও খুলে ফেলেন। শিয়ালকোট থেকে কাঠ এনে কলকাতায় শুরু হল ব্যাট তৈরি, যশোর রোডের কাঠকারখানায় বরাত দিয়ে ব্যাট বানানোর চল শুরু কিরে দিলেন সারদা, এই ব্যাটগুলির দাম ছিল কম এবং সারদা যা চেয়েছিলেন সেই মতোই মধ্যবিত্তবাড়িতে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ঢুকতে শুরু করল ক্রিকেট ব্যাট। ১৯০৬ সালে সারদারঞ্জন তৈরি করলেন ব্যালেন্সড ব্যাট যা অনেকাংশেই আধুনিক ব্যাটের নকশা দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
খেলা আসলে বাঁচারই লড়াই, শিখিয়েছিলেন যে শিক্ষকরা
সারদারঞ্জনের ক্রিকেটের পাশাপাশি কোচিং প্রতিভা দেখে নাটোরের মহারাজ তাঁর ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে চেয়ে বসেন তাঁকে। সারদা নিরাস করেননি রাজাকে। সারদারঞ্জনই প্রথম বাঙালি যাঁর নখদর্পণে ছিল ক্রিকেটের আইন ও ব্যাকরণ।
বিশাল সাদা লম্বা দাড়ির জন্য আজও অনেকে তাঁকে বলে থাকেন বাংলার ডব্লু জি গ্রেস। সেই উনিশ শতকের শেষভাগে, ঔপনিবেশিক ভারতে, অবিভক্ত বাংলার এক অধ্যাপক ক্রিকেটের সাথে পরিচয় করাচ্ছেন বাঙালিকে, বিলিতি খেলার আদব কায়দায় শিক্ষিত হচ্ছে উপমহাদেশ- শুধু ক্রিকেটকে ভালোবেসে নিজের জীবনের একটা বড় অংশ ব্যায় করেছিলেন সারদারঞ্জন রায়, সেই স্বপ্নের প্রতিটি কুঁড়ি আজ ভারতবর্ষের হৃদস্পন্দন, ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো ধর্ম - ক্রিকেট।
Powered by Froala Editor