জঙ্গলের টানেই কর্মজীবনে পদোন্নতি চাননি ‘পদ্মশ্রী’ কালীপদ সরেন

পড়াশোনা শেষ করেই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন কালীপদ সরেন। প্রথম কর্মস্থান ছিল কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় থাকতে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই ১৪ বছরের মাথায় যখনই প্রথম বদলির সুযোগ এল, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সোজা ফিরে গেলেন ঝাড়গ্রামে। জঙ্গলমহলের সেই রূপ, সেই গন্ধ নিয়েই যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেখানেই তাঁর মাটির টান। নাড়ির টানও। তাঁর চেনা সমাজের কথা, সাঁওতাল জীবনের নানা লড়াইয়ের কথা মানুষকে জানানোর ব্রত নিয়েছেন কালীপদ (Kalipada Soren)। আর সেই কাজ কি কলকাতা শহরে বসে হয়?

খেরওয়াল সোরেন নামেই অবশ্য তাঁকে বেশি মানুষ চেনেন। কারণ এই নামেই দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করে আসছেন কালীপদ। লিখেছেন অসংখ্য নাটক। পুরস্কৃতও হয়েছেন। ১৯৫৭ সালে ঝাড়গ্রামের কাছে রঘুনাথপুরে জন্ম হয় কালীপদ সরেনের। বাবা তারাচাঁদ সরেন ছিলেন ঝাড়গ্রামের জমিদারের আমিন। জমিজমাও ছিল খানিক। তাতেই সংসার চলে যেত। পড়াশোনা নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা কেউই করেননি ছোটো থেকে। কিন্তু কালীপদ নিজের চেষ্টায় সেই লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন কাবগাড়ির সেবাভারতী কলেজে। তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেন ১৯৮৪ সালে।

মোটামুটি এই সময় থেকেই কালীপদর ধাররাবাহিক সাহিত্যচর্চার শুরু। সেই বছরই ব্যাঙ্কের চাকরিতে যোগ দেন। আর পাশাপাশি শুরু করেন ‘রিমিল’ নামের একটি সাঁওতালি পত্রিকার সম্পাদনা। ‘রিমিল’-এর পর শুরু করেন ‘মার্শাল গাঁওতা’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনা। কালীপদ কলকাতা ছেড়ে জঙ্গলমহলে ফিরে আসার পরেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলেছিল সেই পত্রিকার কাজ। এমনকি কলকাতা নিবাসী সাঁওতাল জনজাতির মানুষদের নিয়ে তিনি ‘খেরওয়াল ড্রামাটিক ক্লাব’ নামে একটি নাট্যদলও তৈরি করেন।

২০০৭ সালে ‘চেৎরে চিকায়েনা’ নাটকের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান কালীপদ, ওরফে খেরওয়াল সোরেন। ২০১৯ সালে দিব্যেন্দু পালিতের বাংলা উপন্যাস ‘অনুভব’ সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে আবারও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও পেয়েছেন সাঁওতালি লেখক সংগঠনের পুরস্কার, রঘুনাথ মুর্মু ফেলোশিপ, অনগ্রসর কল্যাণ বিভাগের পুরস্কারও। সেই তালিকাতেই এবার যুক্ত হল আরেকটি পালক। পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন কালীপদ। তবে তিনি বলেন, তাঁর সমস্ত সাফল্যই আসলে সাঁওতালি জনজীবনের স্বীকৃতির লড়াই। এই জীবনের টানেই ৩৩ বছরের কর্মজীবনে একবারও পদোন্নতির আবেদন করেননি তিনি। যদি তাহলে জঙ্গলমহল ছেড়ে চলে যেতে হয়! জঙ্গল আর জঙ্গলের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে, যতদিন সামর্থ্য থাকবে কলম চালিয়ে যাবেন তিনি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More