যতদূর দেখা যায় শুধু নীল জলরাশি। এমনই এক ‘দিকশূন্যপুর’ সমুদ্রের মাঝের ছোট্ট একটি জনপদ। আয়তন মাত্র ১.২৫ হেক্টর। সহজ করে বলতে গেলে বড়ো জোর ২টো ফুটবল মাঠের সমান। আর ছোট্ট এই জায়গাতেই গায়ে গা ঘেঁষে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অজস্র বাড়ি। দূর থেকে দেখলে তাদের ভেনিসের মতো ভাসমান মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ব্যাপারটা একেবারেই তেমন নয়। প্রবাল প্রাচীর এবং ছোট্ট একটি দ্বীপের ওপরেই গড়ে উঠেছে এই জনপদ।
কলোম্বিয়া অন্তর্গত ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকেই অবস্থিত এই অদ্ভুত জনপদ। নাম সান্টা ক্রুজ ডে ইসলোটে। কলোম্বিয়ার কার্টাজানা শহর থেকে স্পিডবোটে কয়েক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করলেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। তবে ঘুরে দেখার অনুমতি থাকলেও বহিরাগত কোনো পর্যটককেই থাকতে দেওয়া হয় না এই স্বপ্নরাজ্যে। কিন্তু এমন ধূধূ সমুদ্রের মাঝে হঠাৎ কীভাবে মানুষের বসতি? তার ইতিহাসই বা কী?
স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী এই দ্বীপের জন্ম হয়েছিল ১৮৭০ সালে। কলোম্বিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকেই সেসময় এই অঞ্চলে মাছ ধরতে আসতেন উপকূলবর্তী মৎস্যজীবীরা। সান্টা ক্রুজ আবিষ্কৃত হয় সেই সময়ই। দীর্ঘ সমুদ্রপথ যাত্রা করে তাঁরা সাময়িক বিশ্রাম নিতেন এই দ্বীপে। আর সেই কারণেই গড়ে উঠেছিল কিছু অস্থায়ী বাসস্থান। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের নজরে আসে এই দ্বীপের অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য। সেখানে মশার উপদ্রব নেই কোনো! নেই কোনো বিষাক্ত কীটপতঙ্গও। অন্যদিকে কলোম্বিয়ার মূল ভূখণ্ডে তখন রীতিমতো তাণ্ডব ম্যালেরিয়ার। মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচতেই কয়েকটি মৎস্যজীবী পরিবার সেসময় স্থায়ী বসতি তৈরি করেন সান্টা ক্রুজে।
এক সময়, যেখানে হাতে গুনে বলা যেন বাসিন্দাদের সংখ্যা; আজ দেড়শো বছর পেরিয়ে সেই দ্বীপে বসবাস প্রায় ১২০০ জনের। এমনকি বিশ্বের সবথেকে ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ সান্টা ক্রুজই। আয়তনের ক্ষুদ্র হলেও এই দ্বীপের জনঘনত্ব ম্যানহাটনের প্রায় চারগুণ। তবে সকল বাসিন্দাই এই দ্বীপে রয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। বর্তমানে ছোট্ট কয়েক বর্গফুটের ছোট্ট একটি জায়গাই কেবল ফাঁকা পড়ে রয়েছে এই দ্বীপে। সেখানে দণ্ডায়মান প্রমাণ আয়তনের একটি ক্রুশ। সেটাই স্থানীয়দের কাছে সেলফি-জোনও বটে।
আরও পড়ুন
৩২ বছর নির্জন দ্বীপে একাকী বসবাস ইতালির ‘রবিনসন ক্রুসো’র
প্রশ্ন থেকে যায়, বহির্জগতের সঙ্গে ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকার পরেও কীভাবে জীবনধারণ করেন এখানকার বাসিন্দারা? পেশার দিক থেকে দেখতে গেলে অধিকাংশ বাসিন্দার জীবিকা এখনও নির্ভরশীল মৎস্য শিকারের ওপরেই। নৌকা করেই সেই মাছ তাঁরা রপ্তানি করেন পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দ্বীপে। তাছাড়া বর্তমান প্রজন্মের কেউ কেউ নিকটবর্তী দ্বীপে খুলে বসেছেন বিলাসবহুল হোটেল। তবে মাছ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত খাদ্য এবং পানীয় সবটাই আমদানি করতে হয় বাইরে থেকে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ শুধুমাত্র ওইটুকুই। বাকি সমস্ত ক্ষেত্রেই একেবারে স্বর্নির্ভর সান্টা ক্রুশ। ছোট্ট দ্বীপেই রয়েছে দুটি দোকান, একটি করে রেস্তোরাঁ, স্কুল এবং চার্চ। গোটা দ্বীপের মানুষদের পরিষেবা দেন তাঁরাই। এমনকি ২০২০ সালের আগে পর্যন্ত এই দ্বীপে ছিল না ইন্টারনেটও।
আরও পড়ুন
হঠাৎ জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরিতে বিস্ফোরণ, বিপন্ন সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপ
তবে আশ্চর্যের বিষয়, সবকিছু মজুত থাকলেও সান্টা ক্রুজে নেই পুলিশ প্রশাসন। নেই চিকিৎসকও। স্থানীয়দের দাবি, বিগত দেড়শো বছরের ইতিহাসে কোনো অপরাধের ঘটনাই ঘটেনি এই দ্বীপে। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব বেশ বড়ো সমস্যার কারণ প্রান্তিক এই দ্বীপ রাজ্যে। কিন্তু উপায়ই বা কোথায়? হাসপাতাল বা চিকিৎসালয় করতে গেলেও জায়গার প্রয়োজন। সেটাই আর অবশিষ্ট নেই সান্টা ক্রুজে। আর সেটাই বর্তমানে দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে প্রবীণ বাসিন্দাদের কাছে। আগামী প্রজন্মে কীভাবে জায়গা দেওয়া হবে এই দ্বীপে, তা নিয়েই চিন্তিত তাঁরা। কিন্তু এর পরেও স্বঘোষিত ‘স্বর্গরাজ্য’ ছেড়ে অন্যত্র আস্তানা তৈরিতে নারাজ সহস্রাধিক বাসিন্দাই…
আরও পড়ুন
বাইবেলের দৃশ্য, নিকারাগুয়ার দ্বীপ ও আর্নেস্টো কার্ডিনালের স্বপ্ন
Powered by Froala Editor