সুদূর গ্রিস থেকে বারাণসীতে, অনুবাদ করেছেন একের পর এক বই

গির্জার পাশের কবরস্থানে একটি পুরনো ফলক। আর সেই ফলকে লেখা একটি ফার্সি চৌপদী। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে লেখা ফার্সি কবিতাটি এখনও স্পষ্ট পড়া যায়। বেনারস শহরের গির্জার এই সমাধিটি সত্যিই অবাক করে। আরও অবাক করে কবিতাটির রচয়িতার নাম। লিখেছেন মুন্সী শীতল সিং নামে এক ব্যক্তি। ইতিহাসে তাঁর কথাও জানা যায়। শীতল সিং-এর লেখা ‘সিলসিলা-ই যোগিয়াঁ’ ইউরোপ থেকে আসা বহু ব্যক্তির কাছে হয়ে উঠেছিল উত্তর ভারতের গাইডবুক। সেসব আষ্টাদশ শতকের কথা। সমাধিফলকের এই এলিজিটি শীতল সিং লিখেছিলেন দিমিত্রিওস গ্যালানোস (Dimitrios Galanos) নামের এক ব্যক্তির স্মৃতিতে। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই ইতিহাস মনে রাখেনি।

তবে যেটুকু জানা যায়, সেটুকুও অবাক করার মতো। অষ্টাদশ শতকে গ্রিস থেকে এক ব্যক্তি এসে ৪ দশক কাটিয়েছেন বারাণসী শহরে, এই কথা ভাবতেই অবাক লাগে। ভারতের আবহাওয়ার সঙ্গে ইউরোপীয়দের মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা ছিল চিরকালের। তার মধ্যেই কলকাতা এবং বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে ইউরোপীয়দের বসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপযুক্ত পরিকাঠামোও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বেনারসে সেসব কিছুই ছিল না। প্রায় গোটা শহর জুড়েই ব্রাহ্মণদের বাস। অন্যান্য জাতির মানুষরাও রয়েছেন। কিন্তু সেই শহরের সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন তখনও ঘটেনি। আর সেই কারণেই বারাণসী শহরকেই বেছে নিয়েছিলেন গ্যালানোস। তিনি যে এসেছিলেন ভারতের ইতিহাসের মণিমুক্তো সন্ধান করতেই।

১৭৬০ সালে এথেন্স শহরে জন্ম দিমিত্রিওস গ্যালানোসের। তখনও ইন্ডোলজি বা ভারতবিদ্যা নামে কোনো শাখার চর্চা শুরু হয়নি ইউরোপে। তবে গ্যালানোস ছোটো থেকেই শুনতেন ভারতবর্ষ এবং গ্রিসের প্রাচীন দর্শনের মেলবন্ধনের কথা। শুধুমাত্র দর্শনের জন্যই এত দূরের দুটি দেশ কাছাকাছি এসেছিল। ইতিমধ্যে ল্যাটিন ভাষা এবং সামান্য ইংরেজিও শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পাননি। এমন সময় ১৭৮০ সালে সুযোগ এল ভারতে আসার। ততদিনে কলকাতা শহরে প্রায় ২০০ জন গ্রিক বসবাস করতে শুরু করেছেন। কলকাতা, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের গ্রিক পরিবারগুলির শিশুদের জন্য শিক্ষকতা করতে এই দেশে এলেন গ্যালানোস।

কলকাতায় অবশ্য বেশিদিন থাকলেন না তিনি। বছর দশেকের মধ্যেই চলে গেলেন বারাণসী। আর সেখানেই শুরু হল জীবনের আসল কাজ। চতুষ্পাঠীতে ঘুরে ঘুরে সংস্কৃত শিখেছেন তিনি। ফার্সি শিক্ষা শুরু হয়েছিল কলকাতায় থাকার সময়েই। বারাণসীতেও সেই চর্চা চালিয়ে গিয়েছিলেন গ্যালানোস। আর এই সময়েই বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন মুন্সী শীতল সিং-কে।

প্রথমেই চাণক্যনীতি অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলেন গ্যালানোস। এই একটি অনুবাদই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তাও তাঁর নিজের নামে নয়। নিকোলাস কেপহালা নামের এক গ্রিক নাবিক সেই পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে এথেন্সে গিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করেছিলেন। আবার কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে লিখেছিলেন দিমিত্রিওস গ্যালানোস নামের এক ব্যক্তি তাঁকে এই অনুবাদে সাহায্য করেছেন। গ্যালানোসের নাম তখনই জানতে পেরেছিলেন গ্রিসের মানুষ। কিন্তু তাঁর বিপুল কাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনেক পরে।

১৮৩৩ সালে গ্যালানোসের মৃত্যু হয়। সেই বছর বারাণসী শহরে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা। অনেকে মনে করেন কলেরাতেই মৃত্যু হয় গ্যালানোসের। তবে তারপরেও কী করে তাঁকে গির্জার সমাধিস্থলে জায়গা দেওয়া হল, তাই নিয়ে সংশয় রয়েছে। গ্যালানোসের মৃত্যুর পরেই কলকাতার গ্রিক জনজাতির মানুষদের সূত্রে তাঁর সমস্ত অনুবাদ পৌঁছায় এথেন্সে। নিজের মৃত্যুর সময়ের শেষ ইচ্ছাপত্রে এই সমস্ত পাণ্ডুলিপির স্বত্বাধিকার এথেন্সের অ্যাকাডেমিয়াকেই দিয়ে গিয়েছেন তিনি। বেশ কিছু সঞ্চিত অর্থও দান করেছিলেন অ্যাকাডেমিয়াকে।

এই পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে ছিল ভর্তৃহরি নীতি, বৈরাগ্য শতক, লঘু চাণক্য, ভামিনীবিলাসের মতো সাহিত্য। আবার গীতা বা মার্কণ্ডেয় পুরাণের বেশ কিছু অধ্যায়ও অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তবে বারাণসী থেকে এই সবকিছু গ্রিসে পৌঁছাতেই লেগে যায় ৪ বছর। তারপরেও দীর্ঘদিন সেখানে পড়ে থাকে অবহেলায়, অযত্নে। ১৯৪৫ সালে প্রথম গ্যালানোসের নিজের নামে কোনো বই প্রকাশিত হয়। এছাড়াও গ্রিক-ইংরেজি-সংস্কৃত-ফার্সি চারটি ভাষার একটি মিলিত শব্দকোষ লেখার কাজও শুরু করেছিলেন তিনি। অসম্পূর্ণ হলেও সেই শব্দকোষই বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রিকদের সংস্কৃত শেখার শুরুর পাঠ ছিল। অথচ এমন একজন মানুষ জীবদ্দশায় কোনো স্বীকৃতি পাননি, স্বীকৃতি দাবিও করেননি। শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসকে ভালোবেসে ৪ দশক এই দেশের সংস্কৃতির অধ্যায়ন করে গিয়েছিলেন দিমিত্রিওস গ্যালানোস।

Powered by Froala Editor