বছরের শেষে একটি ছকভাঙা গল্প উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরিচালক লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বার্ধক্যের একাকিত্ব ও স্মৃতিবিলাসের চেনা ছকের মধ্যে এক অচেনা গল্প নিয়ে হাজির হলেন 'সাঁঝবাতি' সিনেমায়। এই প্রথম বড় পর্দায় একসঙ্গে দেখা গেল দেব এবং পাওলিকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দেবের এই প্রথম অভিনয়। 'পোস্ত'র পর ফের একসঙ্গে দেখা গেল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও লিলি চক্রবর্তীকে, দুই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চরিত্রে। 'সাঁঝবাতি' সিনেমাকে ঘিরে তাই স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। এর মধ্যে সুপারস্টার দেবকে গৃহভৃত্যের চরিত্রে তাঁর ফ্যানরা মেনে নেবে কিনা, সেই চিন্তাও ছিল।
সিনেমার শেষে যখন হল থেকে বাইরে আসি, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে তো মনে হল, পরিচালকদ্বয় তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছেন। এমনকি দেবকে চাকরের ভূমিকায় দেখতেও তাঁর ভক্তরা ক্ষুণ্ণ হননি। প্রকৃতই চেনা ছকের বাইরে এসে অভিনয়ে মন কেড়েছেন দেব-পাওলি। প্রত্যাশিতভাবেই অনবদ্য অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও লিলি চক্রবর্তী। সোহিনীর সাবলীল অভিনয় যথারীতি দর্শকদের পর্দার সামনে বসিয়ে রাখে। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও তাদের পরিচারক পরিচারিকার সম্পর্কের মানবিক টানাপোড়েনের চেনা গল্প সিনেমায় উপস্থিত হয় অসংখ্য অচেনা সমীকরণ নিয়ে।
চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধা সুলেখা মিত্র (লিলি চক্রবর্তী) সল্টলেক বি বি ব্লকের 'সাঁঝবাতি' নামের বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। সঙ্গী বলতে একমাত্র পরিচারিকা ফুলি (পাওলি)। সারাদিন ফুলির সঙ্গে সুলেখার খিটিরমিটির চলতেই থাকে। অথচ ফুলিও ছেড়ে যায়না সুলেখাকে, আবার সুলেখাও ফুলিকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারেন না।
গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ছানাদাদু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। ছানাদাদু আর সুলেখা মিত্র, এই দুই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পারস্পরিক একাকিত্ব বিনিময়ের দৃশ্য দিয়েই সিনেমা শুরু হয়। ছানাদাদুর সঙ্গে সুলেখা দেবীর একসময় বিবাহের সম্বন্ধ করা হয়েছিল। জাতিগত গোঁড়ামির কারণে সেই সম্বন্ধ ভেঙে যায়। সেই পরিণতিহীন প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য ভঙ্গিতে হাজির হয় সিনেমায়। যে সম্পর্ক আমাদের প্রত্যেকের চেনা হলেও তার এত সাবলীল প্রকাশভঙ্গি আমরা সচরাচর দেখতে পাই না।
তবে 'সাঁঝবাতি' কেবল এই একাকিত্বের অন্ধকারের গল্প নয়। এর মধ্যেই সমস্ত অন্ধকারের বিপরীতে টিমটিম করে জ্বলছে 'সাঁঝবাতি'। এই বাড়িকে আঁকড়ে ধরেই সুলেখা দেবী তাঁর শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে চান। তাঁর ছেলে বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইলে অশান্তি করেন। তাঁর কথায়, "এই বাড়ি তো শুধু ইঁট-কাঠ-পাথরের তৈরি নয়"; একদিন এই বাড়িতে তাঁর ভরা সংসার ছিল। 'সাঁঝবাতি' সেই স্মৃতির গল্প, যে স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে শহরের আনাচে কানাচে। যার মৃত শরীরের উপর তৈরি হচ্ছে নতুন কলকাতার কংক্রিট-কঙ্কাল। সেই নতুন কলকাতাকে দেখে ছানাদাদুর উপলব্ধি, "এই পুরো শহরটাই একটা বৃদ্ধাবাস হয়ে যাবে।" অথবা তাও না। শহরের বুকের থেকে সুলেখা দেবী বা ছানাদাদুর মতো নাছোড়বান্দা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সরে গেলেই, কলকাতা হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির এক প্রত্যন্ত বাজার। পুরোটাই চলে যাবে প্রোমোটারের দালাল বিশুদের দখলে।
কিন্তু এই আসন্ন অন্ধকারের বিরুদ্ধে সামান্য 'সাঁঝবাতি' আর কতদিন জ্বলবে। শহরের পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে একের পর এক মাল্টি-স্টোরেড বিল্ডিং উঠছে। সেই ঝড়ো হওয়ার সামনে 'সাঁঝবাতি' ভীষণ দুর্বল। ঠিক এই সময়েই মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসে চন্দন ওরফে চাঁদু (দেব)। কেবল পয়সা রোজগারের জন্য সে এসেছিল সুলেখা দেবীর বাড়ির পরিচারক হয়ে। কিন্তু অচিরেই এক মানবিক সম্পর্কের টানে বাঁধা পড়ে যায় সে। শক্ত হাতে আড়াল করে রাখে সাঁঝবাতির শিখা। আগলে রাখে সুলেখা ও ছানাদাদুর নিঃসঙ্গ জীবন। তাদের জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো আসতে আসতে দানা বাঁধতে শুরু করে, বাস্তব হয়ে ওঠে, চাঁদুর তৎপরতায়। আর এর মধ্যেই কখন চাঁদু আর ফুলির সম্পর্কও ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠে। এমন এক নিরুচ্চার অথচ পরিণত প্রেমের সম্পর্ক চিত্রণ নিঃসন্দেহে কাহিনীকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ কৃতিত্ব।
তবে চন্দন কি শেষ পর্যন্ত পারবে 'সাঁঝবাতি'কে আগলে রাখতে? সম্পূর্ণ গল্প বলে না দেওয়াই ভালো। তবে সুলেখা দেবীর মৃত্যু হলে তো 'সাঁঝবাতি' আর নিছক একটা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর "সব বাড়ি ভাঙলেই ইঁট-কাঠ" পাওয়া যায়। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে প্রতিযোগিতার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে ছিঁড়ে যাচ্ছে দুই জেনারেশনের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্ক। মুছে যাচ্ছে স্মৃতির আদানপ্রদান। আর সেখানেই চাঁদু-ফুলির মতো ছেলেমেয়েগুলো বাঁচিয়ে রাখছে মানবিক অস্তিত্বকে। কলকাতাকে তারা বৃদ্ধাবাসে পরিণত হতে দেবে না।
সম্পূর্ণ আলোচনায় বাদ থেকে গেল রূপকথা (সোহিনী) চরিত্রটা। একটা গোটা জেনারেশন যখন লাভ-ক্ষতির হিসাবে স্মৃতিকে শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট বিনে ফেলে দিচ্ছে, তখন রূপকথার মতো কেউ কেউ সারাজীবন স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে থাকছে। সেই স্মৃতি সুলেখা দেবীর ছোট ছেলে, রূপকথার সাথে বিয়ের আগেই যে মারা যায়। সুলেখা-রূপকথার এই আপাত অপরিণত সম্পর্কের দিকটা সিনেমার একটা বড়ো আলেখ্য তৈরি করেছে।
সিনেমার টেকনিক্যাল দিকগুলোর মধ্যে একটা কথা বলতেই হয়, তা হল চিত্রগ্রহণ। মূলত সংলাপনির্ভর এই সিনেমাতেও প্রতিটি শট এত নিখুঁতভাবে নেওয়া হয়েছে যে কোথাও দৃশ্যপট বিঘ্নিত হয়নি। সিনেমার আউটডোর শট ইতিমধ্যে বহুল প্রশংসিত হয়েছে। তবে ইনডোর শট নেবার সময়েও দৃশ্যপটের সাবলীল ক্রমপরিবর্তন প্রশংসার দাবি রাখে।
কিন্তু তারপরেও সিনেমার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটির কথা আলোচনা না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রথমত সিনেমার বিষয়বস্তু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। তাকে দুঘণ্টার উপর দীর্ঘ একটা সিনেমায় প্রসারিত না করলেই ভালো লাগত। বাংলা সিনেমা একটু কম্প্যাক্ট না হলে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছানো কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, সিনেমার পর্দায় সুলেখা মিত্রের সঙ্গে সমানতালে জায়গা ভাগ করে নিলেও ছানাদাদু চরিত্রটা পরিণতি পায়নি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাকে পরিচালকরা আরো একটু ব্যবহার করতে পারতেন। তৃতীয়ত, ফুলি এবং চাঁদু, এদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পশ্চাৎপট থাকার পরেও সেই কাহিনী সম্পূর্ণ হয়নি। কাহিনীকার এই গল্পকে উপেক্ষা করে যেতে পারতেন, অথবা সম্পূর্ণ করতে পারতেন। এছাড়া উপভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। যথেচ্ছ দন্ত্য'স'এর ব্যবহার বেশ শ্রুতিকটু লেগেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় বাঁকবদলের কোন চিহ্ন রাখতে না পারলেও 'সাঁঝবাতি' দর্শকদের ভালো লাগছে। ভালো লাগবে।