চারিদিকে মুক্ত আকাশ, পর্বতের সারি। শান্ত পরিবেশ। তারই মধ্যে বসে আছেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। চারপাশের প্রকৃতির মতোই শান্ত, নিশ্চুপ। যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। বুদ্ধের শান্তি যেন ঘিরে ধরেছে তাঁকে। অমন পরিবেশে এইরকম দৃশ্য দেখাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি ব্যাপারটা। আসল রহস্য লুকিয়ে আছে ভিক্ষুর মধ্যেই। প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বসে আছেন ওখানে! জীবিত নয় অবশ্যই, মমি হয়ে। হ্যাঁ, স্পিতি ভ্যালির সংঘ তেনজিং-এর মমি ভারতের একান্ত নিজস্ব। যাঁকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে অনেক গল্প, অনেক অবাক লাগাও…
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই স্পিতি ভ্যালি। যারা পাহাড় ভালোবাসেন, ঘুরতে যান বা ট্রেকিং করেন, তাঁদের প্রায় সবার কাছেই এটি একটি পরিচিত নাম। সেখানেরই একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ঘিউয়েন। সেখানে গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন সংঘ তেনজিংয়ের মমির কথা, যে কেউ সাদা ঘরটিতে নিয়ে যাবেন। একটা ছোট্ট ঘর; কংক্রিটের দেওয়ালে ঘেরা। তারই মধ্যে কাচের খাঁচায় ঘেরা একটি কালো বস্তু। বস্তু নয়, মমি। সোনালি পাড় দেওয়া সাদা কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে সেটা। এটিই বৌদ্ধ ভিক্ষু তেনজিংয়ের মমি! ছোট্ট চেহারা, একটা হাত সামনের দিকে এগোনো। মুখ খোলা, ভেতরের ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাচের ভেতর পাথরের সঙ্গে টাকাও পড়ে আছে অনেক। অবশ্য মমি নিরুত্তাপ। সত্যিকারের সন্ন্যাসী ভিক্ষুদের কবেই বা এসবের ওপর মোহ ছিল!
সালটা ১৯৭৫। স্পিতি ভ্যালিতে একটি ভূমিকম্প হয়। ওখানকার বাসিন্দাদের কাছে আশ্চর্যের কিছুই নয় এসব। পাহাড়ি এলাকা, ভূমিকম্প তো হবেই। তবে ওই বছর একটি বিশেষ জিনিস হল। টাবু মনাস্ট্রির থেকে ৩০ মাইল এগিয়ে একটি টোম্বের ভেতর পাওয়া যায় একটি দেহ। দেহ মানে, মমি। সেই তখনই সামনে এল সংঘ তেনজিংয়ের মমি। ২০০৪ সালে আজকের জায়গায় নিয়ে আসা হয় পবিত্র দেহটিকে। হঠাৎ পবিত্র শব্দটি কেন? কারণ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে সংঘ তেনজিংয়ের মাহাত্ম্য অন্য জায়গায়। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর মৃত্যু, ও মমি হওয়ার ঘটনাও।
ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতকে হিমালয়ের ওই এলাকায় বসবাস ছিল সংঘ তেনজিংয়ের। একটা সময় ওই এলাকায় খুব কাঁকড়া বিছের উপদ্রব শুরু হল। সঙ্গে ছিল অন্যান্য রোগও। কিন্তু এরকম করলে তো পুরো গ্রাম ছারখার হয়ে যাবে! সেই সময় এই বৌদ্ধ ভিক্ষু, সংঘ তেনজিং সবাইকে গ্রাম ছাড়তে বলেন। বদলে নিজে গ্রামে থেকে যান। বাকিদের বলেন, এই গোটা গ্রামের জন্য আমি নিজেকে বলি দেব। নিজেকে ‘মমি’ বানাব। যখন তার আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন একটি রামধনু উঠবে আকাশে। আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সেই রামধনু উঠেছিল কিনা জানা যায়নি; কিন্তু গ্রামবাসীদের ফিরে আসা প্রমাণ করে, কাঁকড়া বিছে আর রোগ সব থেমে গিয়েছিল। শুধু পড়েছিল সংঘ তেনজিংয়ের মরদেহ। সেখানেই জানা যায় তাঁর মৃত্যু পূর্ববর্তী জীবনযাপন। উপবাসে থেকে মৃত্যু— এই রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন। সবার আগে খাওয়া ছেড়েছিলেন বার্লি, চাল আর লেগুমস বলে একটি খাবার। অর্থাৎ যে খাবারগুলি ফ্যাট বাড়ায়, বিশেষত লেগুমস, সেগুলো আগে ত্যাগ করেছিলেন। আস্তে আস্তে দেহের সব অঙ্গও ছোটো হতে থাকে। সমস্ত ফ্যাট ভেঙে যায়। ঠিক এই পদ্ধতিই তো মেনে চলত মিশরীয়রা! তবে তফাৎ হল, এটা ভারত; এবং এখানে জীবিত অবস্থাতেই একজন মমি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে আরও একটি তফাৎ। স্পিতি ভ্যালির ওই ঘরে গেলে দেখা যাবে, সংঘ তেনজিংয়ের মমি বসে আছে। এরকম দৃশ্য কি দেখেছেন? একজন বসা মমি? এখানে এলে সেই দৃশ্যই দেখা যাবে। ধ্যানরত অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন এই বৌদ্ধ ভিক্ষু। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তিনি ভগবানের থেকে কম না। একটা গোটা গ্রামকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, বদলে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলেন; এটা কি কম কথা!
Powered by Froala Editor