হলুদ হয়ে গেছে পাতার রং। আবছা হয়ে এসেছে কালিও। তবু লেটারপ্রেসের হরফে ছাপা ছোট্ট বিজ্ঞাপনের দিকে তাকালে ঘিরে ধরবেই একরাশ বিস্ময়। সে বিজ্ঞাপনের বক্তব্য অনেকটা এমনটাই, “সেইসব লেখক যাঁরা নির্জনে চুপচাপ লিখে যান, কিংবা কোন লেখা কোন পত্রিকায় প্রকাশ করবেন বুঝতে পারেন না, তাঁদের জন্য তৈরি হল লেখক ব্যাঙ্ক।” সালটা ১৯৯০। অন্তরীপ পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এমনই অভিনব এক বিজ্ঞাপন। কিন্তু কী এই ‘লেখক ব্যাঙ্ক’?
‘কৃত্তিবাস’ থেকে শুরু করে ‘পরিচয়’। ‘কৌরব’ থেকে শুরু করে ‘শতভিষা’। বইয়ের র্যারকে থরে থরে সাজানো জানা-অজানা অজস্র ছোটো পত্রিকা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। কথা হচ্ছে লিটল ম্যাজাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের সম্পর্কেই। কলেজস্ট্রিটের টেমার লেনের এই বাড়ি ছোট পত্রিকার পীঠস্থানই বটে। ১৯৭৮ সালে একক উদ্যোগেই এই পথচলা শুরু করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকর্মী ও লেখক সন্দীপ দত্ত। লক্ষ্য ছিল বাংলা সাহিত্যের এই চলমান ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা। অসুস্থতার মধ্যেও একনিষ্ঠভাবে সেই কাজটা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বিগত ৪৩ বছর ধরে। কিন্তু শুধুই কি লিটল ম্যাগাজিনের সংরক্ষণ? না, বরং অপ্রতিষ্ঠিত লেখকদেরও দাঁড়াবার একটা জায়গা করে দিয়েছিলেন তিনি।
“বহু লেখকই নিশ্চুপে সাহিত্যচর্চা করে যান। কিন্তু কোনো পত্রিকার দফতরে লেখা পাঠানো বা সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওঠা সম্ভব হয় না তাঁদের। তাঁদের জন্যই লেখক ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল। অনেকেই লেখা পাঠাতেন এখানে। তারপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকরা পছন্দের লেখা বেছে নিতেন সেখান থেকে।”
আরও পড়ুন
'ছোটো' পত্রিকার 'ছোটো' পুরস্কার, মঞ্চে উঠে এল লিটল ম্যাগাজিনের বিরাট পরিবার
বলছিলেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কর্ণধার ও প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্ত। তরুণ লেখকদের সাহিত্যের মূলস্রোতে নিয়ে আসতেই এহেন উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের মাথায় ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহীরুহের মতো চিরতরুণ মানুষটা। লেখক ব্যাঙ্কের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সেসময় একাধিক পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশ পেত লেখক ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন। আর সেইসব পত্রিকাদের হাত ধরেই তা পৌঁছে যেত সাহিত্যচর্চা করা পাঠকমহলের কাছে।
আরও পড়ুন
লিটল ম্যাগাজিন থেকে ফুলটাইম প্রকাশনা – বইকেই ‘সর্বস্ব’ করে নিয়েছেন সেলিম
সন্দীপবাবু জানালেন, “কবিতা ছাড়া গদ্য, প্রবন্ধ, গল্প— সবকিছুই জমা দিতে পারতেন লেখকরা। সেগুলো থেকে মনোগ্রাহী লেখাগুলি প্রাথমিক বাছাই করে আলাদা করে রাখতাম। পরে সেখান থেকে পছন্দের লেখাগুলি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকরা।” সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো’রও বেশি লেখা এভাবেই জায়গা করে নিয়েছিল নানা পত্রিকায়।
আরও পড়ুন
লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কলকাতার উৎসাহে মুগ্ধ বাংলাদেশের হাসান রোবায়েত
তবে এই অভিনব লেখক ব্যাঙ্কের আয়ুষ্কাল ছিল অতি সামান্যই। বছর তিনেক চলার পরই লেখক ব্যাঙ্ক বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সন্দীপবাবু। তার পিছনে ছিল মূলত দুটি কারণ। অনেক সময়ই তাঁর থেকে লেখা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার পর অন্য নামে তা ছাপতেন সম্পাদকরা। পাশাপাশি কোথাও যেন থেকে যেত অনিশ্চয়তার অবকাশও। কোনো লেখা ছাপা হল কিনা— সে ব্যাপারেও অবগত হতে পারতেন না লেখকরা। এই দুই সমস্যার জন্যই ১৯৯২ সালে থেমে যায় লেখক ব্যাঙ্কের পথ চলা। আর সন্দীপবাবু?
কলকাতা বইমেলা তো বটেই, পাশাপাশি শহরতলি ও প্রান্তিক অঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলিও অনালোকিত থেকে যায় তাঁকে ছাড়া। আজও নিরলসভাবেই তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যাগুলি। সন্তানস্নেহেই তাদের জায়গা করে দিচ্ছেন লাইব্রেরিতে। লালন করছেন চলমান বাংলা সাহিত্যের দিনলিপিপে। গত ২৩ জুন পেরিয়ে গেল এই লাইব্রেরির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাদিবস। অসুস্থতা নিয়েও এমন সাহিত্যসাধনা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব…
Powered by Froala Editor