তখনও স্বাধীনতা আসতে কিছু বছর দেরি। কলকাতার এক বাড়ির ছাদে আড্ডা বসেছে কয়েকজনের। কেউ তরুণ, কেউ একটু বয়সে বড়ো। কিন্তু প্রত্যেকের সুতো একটাই— কবিতা, এবং মানুষ। একদিকে শব্দের যাপন, অন্যদিকে চারিদিকে বেড়ে চলা সমাজের চিত্র, সমস্ত কিছু নিয়েই আলোচনা চলছিল। সেই দলেই ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পদাতিক কবিতাটি তখনও প্রকাশিত হয়নি কোথাও। এই বাড়ির ছাদেই পকেটে করে নিয়ে এসেছিলাম কবিতাটির প্রথম খসড়া। সবার অনুমতি নিয়ে পাঠ করা আরম্ভ করলেন। শেষ করার পর রীতিমতো ভয়ই লাগছিল তাঁর; কে জানে কীরকম হয়েছে! সেই সব সন্দেহ দূর করে দিলেন আরেক মহীরুহ। সমর সেন। হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘তুমি তো আমাদের ভাত মারবে হে!’ কিন্তু কে এই সমর সেন? তরুণ প্রজন্ম সত্যিই চেনে তাঁকে?
সমর সেনের পরিচয় ‘ফ্রন্টিয়ার’-এই থেমে যেতে পারে না। তিনি একজন কবি, একজন চিন্তাবিদ, একজন সাংবাদিক। যিনি সবার আগে রেখেছিলেন মানুষকে। তাঁর জীবনের গল্প বাকিদের থেকে একটু আলাদাই হবে, তাতে আর আশ্চর্য কোথায়! ছাত্রজীবনে ছিলেন কৃতীদের মধ্যে একজন; ইংরেজির এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম হন। সেইসঙ্গে বেছে নিয়েছেন কবিতাকেও। বন্ধুবৃত্তেই তখন ঘোরাফেরা করছে তাঁর লেখা। স্কটিশ চার্চ কলেজের ম্যাগাজিনে, শ্রীহর্ষ এবং পূর্বাশা পত্রিকাতেই তখন বেরিয়েছে তাঁর লেখা। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তখনও তিনি তরুণ। এমন পরিস্থিতিতেই আলাপ বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। তখন ‘কবিতা’ পত্রিকা নিয়ে একটা হইচই ফেলার পরিকল্পনায় রয়েছেন তিনি। সেই দলেরই সদস্য হলেন সমর সেন। ফর্সা, তীক্ষ্ণনাসা যুবকটি কখন যে কবিতা’র অন্যতম সম্পাদক হয়ে গেলেন, বুঝতেই পারলেন না…
বুদ্ধদেব বসু অবশ্য আলাপের দিন থেকেই মুগ্ধ ছিলেন তাঁর প্রতি। সেই আলাপ ক্ষণিকের হলেও, তা সমর সেন সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচয় দিয়ে যায়। নিজে থেকেই বুদ্ধদেবের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এবং গিয়ে সপাট বক্তব্য, ‘শাপভ্রষ্ট’ কবিতাটির একটি ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। সেটি দিতেই এসেছেন। সমর সেন এমনই, সোজাকে সোজা হিসেবে বলার সাহস তাঁর আছে। আর সেটা প্রথম আলাপেই বুঝে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। পরিচয় পেয়েছিলেন তাঁর কবিত্বশক্তিরও। তাই ‘কবিতা’ পত্রিকার যাত্রায় সমরই হবেন তাঁর অন্যতম সহকারী, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর।
‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যায় সমর সেনের লেখা কবিতা পড়ে নিজের মুগ্ধতা জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ইতিমধ্যে তাঁর কবিতার অনুবাদ পৌঁছে গিয়েছে লন্ডনে। এডওয়ার্ড টমসন আধুনিক ভারতীয় কবিতা নিয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন তাঁর কবিতা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তাঁর কবিজীবনের আয়ু খুবই সীমিত ছিল। মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দেন তিনি। এর মধ্যেই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু ১৯৪৬-এর পরে আর কবিতার জগতে এলেন না তিনি। কেন? পরের দিকে এই প্রশ্নটা করা হলেই বলতেন, ‘এবার র্যা বোঁর উদাহরণ টানবে নাকি?’ অবশ্য তারপর বলতেন, ঢের হয়েছে। থাক। লিখলেও নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন সেসব। কেন? ওই একই উত্তর, ‘ঢের হয়েছে…’
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাঙালি চিরকালই একটু বেশি আবেগপ্রবণ। সমর সেনের মতো কিছু মানুষই সেসব অতিরিক্ত আবেগকে ঝেড়ে ফেলে উঠেছিলেন। কোনদিনই তাঁকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করেননি তিনি। তবে সান্নিধ্যও লাভ করেছেন কয়েকবার। ওইটুকুই। কবিতার জগত ছাড়লেও বারবারই সামনের সারিতে উঠে এসেছে তাঁর নাম। সাংবাদিকতার সূত্রে কলম তো থেমে থাকেনি! লিখে গেছেন সমানে। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে মস্কোয় অনুবাদের কাজ; তারপর হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড। শেষ পর্যন্ত নিজের ‘ফ্রন্টিয়ার’-এই থেকেছেন তিনি। ১৯৬৭ সাল থেকে যে পত্রিকার যাত্রা শুরু। অনেক কষ্ট করে কাজ করেছেন একসময়, খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়েও গেছে এই উদ্যোগ। কিন্তু আদর্শের দিক থেকে কখনও নিজেকে বিচ্যুত করেননি। কোনো দলীয় রাজনীতি করেননি বলেই নিজেকে মুক্ত রেখে কথা বলে গেছেন। এখানেও তিনি সোজা, সপাট। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেইভাবেই দেখে গেছেন সবটা। এইসবের মধ্যে কবি সমর সেন কি কোথাও চাপা পড়ে যাচ্ছিলেন? কবিতার জগত ছেড়ে গেলেও, কবিতা কি ছেড়েছিলেন তিনি? রাত বিরেতে কখনও কি লিখে ফেলতেন না? এমনই ছিলেন তিনি, ছাই চাপা আগুনের মতো।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কবিসম্মেলনে ডাক পান না গীতিকাররা, আক্ষেপ করতেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার