কুয়াশায় ঢাকা মাঠ, ছেড়ে গেছেন সতীর্থরাও; গোললাইন আগলে একা দাঁড়িয়ে স্যাম বারট্রাম

গোটা মাঠ ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশায়। সেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে এগোতে পারছে না শক্তিশালী টর্চের আলোও। তবুও সব কিছু রুটিনমাফিক মিলিয়ে দেখা নেওয়া তো তাঁর কর্তব্য। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের সাইডলাইন ধরেই তাই শেষবারের মতো পর্যবেক্ষণ করছিলেন এক পুলিশ অফিসার। তবে গোলপোস্টের কাছে যেতেই চমকে উঠলে তিনি। কুয়াশার ভিতর অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যেন একটি মানুষের অবয়ব। খেলা থেমে গেছে মিনিট পনেরো আগেই। থিতিয়ে এসেছে স্টেডিয়ামে দর্শকদের ভিড়ও। তবে মাঠে কেউ অনুপ্রবেশ করল নাকি? খানিকটা ছুটে গেলেন তিনি সেই ব্যক্তির দিকে। অবাক হওয়ার পালা শেষ হয়নি তখনও। দূর থেকে যাঁকে দেখে ছুটে এসেছেন তিনি, সামনে গিয়ে দেখলেন সেই ব্যক্তি স্বয়ং স্যাম বারট্রাম। মাঠে পুলিশ দেখে তিনিও বেশ হতচকিত ততক্ষণে।

ফুটবলের ইতিহাসে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনার মধ্যে অন্যতম এটি। এখনও পর্যন্ত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না নিশ্চয়ই, ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন চেলসির ঘরের মাঠ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে? এবার শুরু থেকে বলা যাক। দিনটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৩৭ সালের বড়দিনের মরশুমেই মুখোমুখি সমরে নেমেছিল চেলসি এবং চার্লটন এফসি। বিরতির পর শুরু হয়েছে দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। স্কোরকার্ডে তখনও ম্যাচের ফলাফল ১-১। 

তবে যত বিকেল গড়াতে থাকল, স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ঘন হতে থাকল লন্ডনের কুখ্যাত কুয়াশা। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছিল সেদিন যে, রেফারি আর ম্যাচ-অফিশিয়ালরাও সিদ্ধান্ত নিলেন খেলা বন্ধ রাখার। ঘড়ি তখন জানান দিচ্ছে, খেলার ৬১ মিনিট অতিবাহিত। দু’দলের সব খেলোয়াড়রাই মাঠ ছেড়ে এগোলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। শুধু মাঠে থেকে গেলেন চার্লটন এফসির কিংবদন্তি গোলকিপার স্যাম বারট্রাম। হ্যাঁ, ১২০ বাই ৮০ মিটারের সবুজ পিচে তিনি একা দাঁড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘ ১৫ মিনিট। আগলে রেখেছিলেন চার্লটন এফসির জাল।

দ্বিতীয়ার্ধে শুরু থেকেই অল-আউট অ্যাটাকিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন চার্লটনের ফুটবলাররা। অন্যদিকে আক্রমণের ঝাঁঝ সামলাতে চেলসির খেলোয়াড়রা একেবারে নিচে নেমে সামলাচ্ছিলেন ডিফেন্সিভ লাইন। কাজেই রেফারির অবস্থানও ছিল চেলসির গোলের কাছেই। খেলা বন্ধ হওয়ার পর রেফারি–সহ সমস্ত খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়লেও, কেউ খবর পৌঁছে দেননি বারট্রামকে। অন্যদিকে তিনি মিনিটের পর মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন গোললাইন আঁকড়ে। ঘন কুয়াশা ভেদ করে দৃষ্টিশক্তিও চিহ্নিত করতে পারেনি, সামনের মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা। শেষ পর্যন্ত এক পুলিশ অফিসার এসে উদ্ধার করেন তাঁকে।

ইংল্যান্ডে প্রায় সব সংবাদপত্রেই জায়গা করে নিয়েছিল এই অবিশ্বাস্য ঘটনা। স্যাম বারট্রাম নিজেও পরবর্তীকালে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন ৩৭-এর সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের বিবরণ। সেইসঙ্গে দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন সতীর্থদের মানসিকতা ও ব্যবহার নিয়ে। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ড্রেসিংরুমে তাঁর অনুপস্থিতি কাউকে ভাবিয়ে তুলল না একবার? এই খেদ যেন চিরকালই সঙ্গে থেকে গিয়েছিল তাঁর।

আর থাকবে নাই বা কেন? ইংল্যান্ডে তৎকালীন সময়ে ফর্মের শিখরে বারট্রাম। ‘আইকনিক গোলকিপার’ বলতে যা বোঝায়। তাঁকে পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, স্পার্স, চেলসি এফসির মতো দল। সামনে বড়ো অঙ্কের অফার, সোনার টিমে খেলার সুযোগ। অথচ চার্লটন এফসি ছেড়ে কোথাও যাননি তিনি। নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন এই ব্রিটিশ ক্লাবকে। তাঁর তো এমন ঘটনায় অভিমান হওয়ারই কথা!

আরও পড়ুন
মিস করেননি একটিও ম্যাচ, সদ্যপ্রয়াত দম্পতিকে বিরল সম্মাননা তুর্কির ফুটবল ক্লাবের

তবে এখানেই শেষ নয়। স্যাম বারট্রামের গোটা জীবনটাই যেন এমন সব অবিশ্বাস্য ঘটনায় মোড়া। ১৯৪৭-এর ২৯ মার্চের কথা। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে এফএ কাপ সেমিফাইনালে সেদিন প্রতিপক্ষ নিউক্যাসেল ইউনাইটেড। গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচ যে কীভাবে উতরাবে চার্লটন, তা নিয়েই চিন্তার ভাঁজ কর্তৃপক্ষের কপালে। কারণ, ফুড পয়েজেনিংয়ে আক্রান্ত প্রধান গোলকিপার ও অধিনায়ক স্যাম বারট্রাম। পাশাপাশি সেদিন তাঁর বিবাহও। তাঁকে বাদ রেখেই টিম সাজিয়েছিলেন কোচ। তবে খেলা শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে সকলকে চমকে দেন বারট্রাম। ওষুধ খেয়েই লড়ে গিয়েছিলেন তিনি ৯০ মিনিট। ম্যাচের ফলাফল ৪-০। অসুস্থতা নিয়েও অনবদ্য পারফর্মেন্সে ক্লিনচিট বজায় রেখেছিলেন বারট্রাম। 

চার্লটনের হয়ে রেকর্ড সংখ্যক প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচও খেলেছেন তিনি। কোনো একটি ক্লাবের হয়েই খেলেছেন ৫৭৯টি ম্যাচ। প্রায় ৭ দশক পর সেই রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন ম্যানচেস্টারের রায়ান গিগস। তাও ২০১২ সালে। শুনলে অবাক লাগবে ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ফুটবল খেলে গেছেন বারট্রাম। না, তখনও তাঁর পারফর্মেন্স ছিল দেখার মতোই। এমনকি ৪০ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড ফুটবলার অফ দ্য ইয়ারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। 

আরও একটা ঘটনা উল্লেখ না করলে হয়তো খানিকটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বারট্রামের বর্ণময় ফুটবল ক্যারিয়ারের বর্ণনা। ১৯৪৬ সালের এফএ কাপ ফাইনাল। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের শেষের দিকে খেলা চলছে তখন। প্রতিপক্ষ ডার্বি কাউন্টির স্ট্রাইকার হার্বাট টার্নারের শট ফিস্ট করেন বারট্রাম। ফিরতি বলে আবারও একটা শট। এবার ছুটে আসা বলকে বুকে আঁকড়ে ধরলেন বারট্রাম। তারপর ছুঁড়ে দিলেন লেফট ব্যাকের দিকে। তবে বলটা মাঠে পড়েও যেন লাফাল না। রেফারি-সহ সকলেই বেশ অবাক। নিজেও হেসে ফেললেন বারট্রাম। কারণ তাঁর হাতের ঘুঁষি খেয়েই ফেটে গেছে ফুটবলের ব্লাডার! সেই ম্যাচে যদিও বাড়তি সময়ে ৩টি গোল হজম করতে হয়েছিল বারট্রামকে। ৯০ মিনিট পর্যন্ত ১-১ বজায় রাখার পরও ৪-১ গোলে হেরে রানার্স হয়েছিল চার্লটন এফসি।

আরও পড়ুন
‘আমাদের অর্থ নেই, অস্ত্র নেই, আছে শুধু ফুটবল’, বিপ্লবী মারাদোনা ও এক প্রতিশোধের গল্প

যাই হোক ১৯৩৭-এর সেই কুয়াশায় মোড়া ঐতিহাসিক ম্যাচের একটি ছবি হামেশাই ঘুরে বেড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে বিষয় হল, সেই ছবিতে স্যাম বারট্রাম নেই। ছবিটি সত্তরের দশকে তোলা একইরকম অন্য একটি ম্যাচের ছবি। সেদিনের কোনো ছবিই নেই কারোর কাছে। শুধু রয়ে গেছে ইতিহাস, সেই পুলিশ অফিসারের বয়ানের লিখিত দলিল আর চার্লটন ক্লাবের মিউজিয়ামে একটি ফলক। যাতে বর্ণনা রয়েছে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার…

Powered by Froala Editor

More From Author See More