১
নিজের বই ‘লুথেরান লেটার্স’-এ পিয়ের পাওলো পাসোলিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যা আশাহীন ভাবে রুগ্ণ, অসম্ভব ক্লান্ত এবং ভবিষ্যৎহারা’... বলেন, ‘এবং আমি সবসময়েই চেয়েছি আদিম শুদ্ধতার কাছে ফিরতে, যা কার্যত অসম্ভব!’ - মধ্যযুগীয় আখ্যানত্রয়ী নিয়ে ‘ট্রিলজি অব লাইফ’ ছবি করা হয়ে গেছে, অতঃপর ভেবেছেন ‘ট্রিলজি অব ডেথ’ করবেন... এবং সেই ত্রয়ী-র প্রথম ছবি ‘সালো’... ‘সালো’ যা মুক্তির পর তিনি নিহত হন... যে খুনকে তাঁর বন্ধুরা কেউই সহজ ভাবে নিতেন না, নেন নি; আলবার্তো মোরাভিয়া অন ক্যামেরা বলেছেন ‘চক্রান্ত আছে’, তাঁদের নিশানা ছিল ইতালির সরকার... পাসোলিনি সর্বত্র লাথ খেয়েছেন যা আজ বিদিত; স্কুল থেকে তাড়া (অভিযোগ ছিল পেডোফিলিয়া ও সমকামিতা-র), কমুনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার (অভিযোগ - ফের সমকামিতা), সমাজ ও মিডিয়ার হানাদারি... লাগাতার…
৫১ বছরের যুবকটি, যাই বলুন, অত্যন্ত নাটকীয়, বর্ণময়... লেখা... দিস্তে দিস্তে, উপন্যাস... ১,.২,৩,...৬ টা, কবিতা... হাজার হাজার পাতা, চিত্রনাট্য... অনেক, ফিল্ম... মোরাভিয়া বলেছেন ‘আরো অনেকগুলো বানানোর ইচ্ছে ছিল... সালোর পরেও’... তাঁর ছিন্নভিন্ন লাশ... থেমে যাওয়া, আটকে যাওয়া, নীরবতা, ছেদচিহ্ন, মিথ হয়ে যাওয়া, অর্থাৎ আদর্শ অ-সুখী ছোটো জীবন এবং মৃত্যু - যা হতই, ভবিতব্য, এনাদের যেমন হয়... পাসোলিনি, অর্থাৎ এক্টিভিস্ট, কবি, কলমচি, বিদ্রোহী, ছবিওলা, সাংবাদিক ... আমাদের সময়ের শহীদ, বুচার্ড খ্রিস্ট, পবিত্র মাংস... ঈশ্বর! কেন তুমি আমাকে পরিত্যাগ করলে! – ... নীরবতা। ... নীরবতা।
কেননা আমাদের আর কোনো রাস্তা নেই, কেননা আমরা প্রফেসি শুনেছি, ... চাক্ষুস করেছি... কেননা শেষ ছবি সালো-তেই নরক নির্মাণ হয়েছে, আসলে নরকের পুনর্বিন্যাস... রি-ইন্সটলেশন, ওটা আর কিছুই না, দান্তে-র দিভিন্না কম্মেদিয়া অর্থাৎ ডিভাইন কমেডি-র সাড়ে তিনটে পর্ব, এবং মার্কি দ্য সাদ-এর উপন্যাস, ১২০ দিনের পায়ুপ্রহার, তার কালপর্ব ছিল ফরাসি বিপ্লব, সে তো একটু দূরে হয়ে যাবে! …ফাসিস্ত ইতালিতে পাসোলিনি সময় সূচক সরিয়ে আনলেন, ছবি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, ফাসিস্ত জমানার পর যখন ৩০ বছর অতিক্রান্ত, নয়া-পুঁজিবাদ ও ভোগবাদী সভ্যতা নিয়ে পাসোলিনি খুব শান্ত ভাবে বলেছেন যা আমরা অন-ক্যামেরা দেখে থাকব ...‘এটা আর কিছুই না সব কিছুইকেই ‘বস্তু’, বস্তুও না, ‘জিনিস’, হ্যাঁ, জিনিস-এ পরিণত করে’, ‘মাল’, খারাপ কথায়, ‘সালো’ আমাদের কাছে কেন কষ্টকর? এখনও, স্নাফ ফিল্মের যুগেও... পীড়াদায়ক? –রক্তারক্তি... না, না, অনেক অনেক বেশি রক্ত, নোংরা, বদখত তো আমরা দেখেছি, অনেক অনেক, ‘এ সার্বিয়ান ফিল্ম’, গঞ্জো ফিল্ম, হলোকস্টের ফুটেজ, আইসিস-এর ফুটেজ, অনেক অনেক, ক্যানিবাল মুভিজ, স্প্লাটার মুভিজ, ‘টেক্সাস চেইন স’ ম্যাসাকার’, অনেক...
লেটস মেক আ পর্নো, পাসোলিনি কাঁধ ঝাঁকাচ্ছেন... কেনই বা নয়!...সভ্যতা? ইতিহাস? প্রগতি? মা-ন-ব-তা!... চ্চ, জিভ দিয়ে শব্দ করলেন কেননা ভুল হচ্ছে, হাস্যকর ভুল, আমরা বিভ্রমকে পুজো করি, বিভ্রমের দাসত্ব... বাস্তব আমাদের কাছে বিভ্রম হিসেবে আসে- আমরা বাস্তবের ‘মানে’ দাঁড় করাই যেহেতু সত্যি সর্বদাই ঘেন্নার... যদি মানুষকে ‘সত্তা’, ‘শরীর’ ও ‘প্রসাধন’- তিনের মধ্যে একটি বাছতে দেওয়া হয় জানা আছে সক্কলে ‘সত্তা’ই বাছবে, আদতে যেটা গল্পে পড়া ভূতের মতো, কেননা... কে দেখেছে? –আসলে যা ঘেন্নাকর সত্যি... তা হচ্ছে ‘প্রসাধন’, মেক আপ, ফলস, নিজের কাছে নিজেরই প্যারোডি, ইতিহাসের কাছে ইতিহাসের!... আসুন, ডিভাইন কমেডি, তারও প্যারোডি, মার্কি দে সাদ-এর গল্প, তারও, পটভূমি ইতিহাস, তারও,... দান্তে হলেন পুরাণ, সাদ হলেন ফিকশন, ফাসিস্ত ইতালি হচ্ছে রিয়াল... সালো চলচ্চিত্রটি অতএব হয়ে দাঁড়ায় পুরাণ-ফিকশন-রিয়াল এই তিন বাহুর সমন্বয়ে একটি ভয়াল ত্রিকোণ!
আরও পড়ুন
বার্গম্যান, তারকোভস্কি-র মতোই শব্দের অভিনব প্রয়োগ মেলে সত্যজিতের ছবিতেও
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-এর ‘পিকু’ হয়তো সম্ভব হত না বার্গম্যানের একটি ছবি না দেখলে
২
ছবিটি আমরা সকলেই দেখে থাকব... দুর্গে সাতজনকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে, এক জন পালাতে গিয়ে খুন হয়েছে, বাকিরাও হবে, যেটা আগেই জানিয়ে দেওয়া হল, এবং ‘সকল’কেই, যারা হবে এবং যারা দেখবে। …একত্রে, সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছে দেবদূত-সম যুবক যুবতীরা .. বাইরে সুন্দর প্রকৃতি... সবুজ ঘাস, নদী, পাখির ডাক, রৌদ্র, স্থাপত্য, জায়গাটা সত্যিই সুন্দর... ওহ না, চ্চ, এটা তো ৪০ দশক, ফাশিজম, তাহলে তত সুন্দর না, বলুন! সর্বত্র, সর্বত্র নরক... দুর্গের বাইরেটাও, ভেতরটাও। ...পয়সা দিয়ে সিনেমা দেখছি, পয়সা উশুল করে ফিরে যাব, আগামী দু ঘন্টা ধরে আমরা আশ্বস্ত হতে চাই... যা আমাদের হকের পাওনা! সিনেমাহলের মধ্যে, ভিড়ে, অন্ধকারে... দুর্গের দরজা দিয়ে ছেলেমেয়েগুলো ঢুকছে, আমরাও ঢুকছি, দুর্গের দরজা বন্ধ, হলের দরজাও বন্ধ, শুরু হচ্ছে ফার্স্ট সার্কল, ‘আঁশটেমির চক্র’ (Circle of Mania)... প্রৌঢ়া গভর্নেস অশ্লীল গল্প বলছে, অস্ত্রধারী যুবকেরা পাহারাদার এবং চারজন ফাশিস্ত প্রৌঢ়, যারা এই নিরীক্ষাটির দায়িত্বে আছে।... যাঃ এরা তো যা ইচ্ছে তাই করছে, এবং এই-ই করে যাবে - এরপর ‘গুয়ের চক্র’ (Circle of Shit), তারপর ‘রক্তের চক্র’ (Circle of Blood).. এই চলবে... মানেটা কী? পয়সা খরচ করে দু ঘণ্টা... রেপড, লিঞ্চড, বুচার্ড হতে এসেছি! ক্ষীয়মাণ আশা, তবু... যদি ওদের ছেড়ে দেয়! যদি আমরা ছাড়া পাই!... অন্ধকার হলঘরে সবাই বন্দি, বিভীষিকা, মারণ যজ্ঞ... কেন দেখব, কেন বসে থাকব!
- আরেঃ, উপায় নেই তো, ‘ওদের’ আর ‘আমাদের’ যে মিশিয়ে দিয়েছে, একাত্ম, একীভূত, এক করে দিয়েছে, আমরাই হচ্ছি ওরা, আমাদের পায়ুই ফাশিস্তগুলো মেরে নিচ্ছে, আমাদেরই সামনে মলত্যাগ করে তারপর খেতে বলছে, না খেলে খুব মারছে, আমাদের যদি নিহত মায়ের কথা মনে পড়ে? যদি আমরা ডুকরে কাঁদি? চিৎকার করে বলি ‘একটু দয়া করুন!’ ‘একটু সোলেস!’ ‘ওঃ ঈশ্বর’! কিন্তু এখানে ফাশিস্ত আইন চলছে, পরিশীলিত জঙ্গল, তোমার কান্না ওদের আরো উশকে দেবে, কান্না, শিকনি, রক্ত, পায়খানা – কেননা মূল্য সকলের এক... নিৎশে-র কুখ্যাত ‘জিনিওলজি অব মরাল’ বারবার আওড়ানো হচ্ছে... নাস্তি, শূন্যতা, নৈরাজ্য... কী আসে যায়? কিচ্ছু না, যে দেখছে (ক্যামেরা) সেও নৈর্ব্যক্তিক, নির্বিকার, সাক্ষী, গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক... চারটে লোক টেবলে বসে কথা বলছে - প্রথম দৃশ্য, সিমেট্রি মেনে বসানো ক্যামেরা, দুর্গ দেখছি, তখনও সিমেট্রি, মানুষ দেখছি, ফিগার, পূর্ণাবয়ব, পুলিশি চোখ, সিমেট্রি, ফ্রন্ট প্রোফাইল, সাইড প্রোফাইল, বিশুদ্ধ অংক, জিওমেট্রি, চিহ্নমালা, সেন্টিমেন্ট-এর শেষ চিহ্নটুকু লোপ করা চাই, সংযুক্তির শেষ শাঁসটুকু... চেঁচে দাও... কোনো বিভ্রম নেই কেননা সব নিক্তি মাপা, স্টেরিলাইজড, শুদ্ধ, কোনো প্রটাগনিস্ট নেই কাজেই বার্লেস্ক, দুর্গের দেওয়াল ভর্তি ছবি - দাদাইজম, ফিউচারিজম, আধুনিক সভ্যতা... অন্তহীন পর্নো... আগুন ও রক্ত... দাঁড়িয়ে থাক জন্তুগুলো... তোদের স্লাট বানাবো, ‘জিনিস’-এ বদলে দেব, কঞ্জিউমারের দল, দাঁড়িয়ে থাক... ভয়ে, ঠান্ডায়, অসহ্য ভিড়ে, দুঃসহ নির্জনতায়...
৩
এবং ছবির শেষে... আমাদের হয়তো মনে থাকবে, গু-ভর্তি বাথটবে চার পাঁচটি তরুণীর মধ্যে একজন, (সকলেই শেকলে বাঁধা ছিল) সে চিৎকার করে বলে ‘ভগবান কেন আমাদের পরিত্যাগ করলে’... সভ্যতার মুক্তিদাতা যিশু-কে আজ এই পশুত্বে অবনমিত দেখি... যে প্রৌঢ়া গভর্নেস এই নরক দেখে অসাড় হয়ে গেল আর শেষমেশ জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল উদ্যানে – তার নিথর দেহটি দেখতে পাই উপর থেকে, নির্বাচিত ‘ফাটল’ দিয়ে প্রকৃতি এবার ঢুকে আসে... দুর্গের ভেতর, যে দমবন্ধ নরকে নিজেদের রেখেছি, তার বাইরে একটি ব্যাপক, নির্বিকার, অব্যয়, শুভাশুভের-অতীত জগত আছে... ক্রমে আমরা শুনতে পাই পাখির ডাক, দেখতে পাই সবুজ ঘাস, বৃক্ষ, রোদ্দুর... সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেলে তার দায় কেবলই মানবের ওপর বর্তায়... বস্তুজগৎ ও প্রাণমণ্ডলে এখনও আদিম শুদ্ধতা রয়ে গেছে এবং চিরকাল থাকবে... আমরা সবকিছু নোংরা করে ফেলতে কোনও দিনই পারব না, কেননা এই সৃষ্টি আদতে অসীম, আমরা অর্থাৎ স্বার্থপর রুগ্ন নৈরাজ্যবাদীরা কেবল নিজেদেরই হত্যা করতে পারি!
... দুঃস্বপ্নের মতো দেওয়াল জোড়া দাদাইস্ট ছবির মুরাল, ঘরটির মধ্যে সঙ্গীত চালিয়ে যে দুজন অস্ত্রধারী তরুণ পরস্পর হাত ধরে নিরর্থক নাচ শুরু করে এবং কথা বলতে থাকে... আমরা ক্রমে জানি যে একজনের প্রণয়ীর নাম মার্গারিটা, সেই ‘অদেখা’ মেয়েটি আমাদের আওতার বাইরে... তার অস্তিত্ব শুধুই কল্পনায়... যেমন পাখি বা সূর্য কাউকেই আমরা দেখতে পাই না, নীরব ও নিহত ঈশ্বরের মহিমা... ঘন নীল আকাশ... বহুদূর ব্যপ্ত উজ্জ্বলতা... সব শেষ হয়ে যাচ্ছে কাজেই কেবল নীরবতা... নিউক্লিয়ার হিমে গ্রহটি অন্ধ হয়ে থাকবে... যুগের পর যুগ... আমাদের যিনি সত্যিই ভালবেসেছিলেন, আমরা যাকে চোখ থাকতেও চিনতে পারিনি, আমাদের পাপের জন্য যিনি রক্ত দিলেন... অন্তিম স্বস্ত্যয়নে পিয়ের পাওলো পাসোলিনি ফিসফিস করে বলেন, ...ক্ষমা, ক্ষমা। ...ক্ষমা।
ছবি - সালো, অর হান্ড্রেড টোয়েন্টি ডে’জ অব সোডোম
পরিচালনা – পিয়ের পাওলো পাসোলিনি
মূল কাহিনি – মার্কি দ্য সাদ
সাল - ১৯৭৫
দেশ – ইতালি
Powered by Froala Editor