গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

অন্যান্যদিনের মতোই আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসের মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট দোকানটি ব্যস্ত। খদ্দেরও আসছে মাঝেমধ্যে। এমন সময় নিতান্ত সাধারণ একটি পোশাক পরে হাজির হলেন এক ভারতীয়। বলা ভালো, বাঙালি। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখ গেল একটি সেতারের দিকে। দিব্যি দেখতে; কেনার আগে একবার দেখলে ক্ষতি কি! কিন্তু সেতারটি বেশ উঁচুতে রাখা। দোকানের কর্মীটিরও যেন ইচ্ছে নেই এই ভারতীয়কে বাজনা দেখানোর। হই হট্টগোলের মধ্যে হাজির হলেন দোকানের মালিক। কিছুক্ষণ পর সেতারও নামল; তারপর দোকানের মধ্যেই সেটা নিয়ে বসে পড়লেন সেই বাঙালি ভদ্রলোকটি। একটু একটু করে ভিড় জমে গেল দোকানে। আমজনতা, দোকানের কর্মী থেকে মালিক— প্রত্যেকে অবাক! রবিশঙ্করের থেকে কম কিছু নয় এই বাজানো! কী করে এমনটা করলেন ইনি? অবশ্য ওঁরা কি তখনও সলিল চৌধুরীকে চিনতেন?

তাঁর নামটিই যেন ভারতের সঙ্গীত জগতের এক বহমান ধারা। যেখানে এসে মিশেছে পাশ্চাত্য সুর, বলিউড, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের সুর। সলিল চৌধুরীর নাম এলে বাংলা এবং মুম্বইয়ের সিনে জগতের অজস্র গল্প তো আসবেই। উঠে আসবে এক বহুমুখী প্রতিভাধর স্রষ্টার কথা। তবে সলিলের উত্থান তো সিনেমাকে ঘিরে হয়নি। বরং সেখানে জুড়েছিল বাংলার আন্দোলন, জুড়েছিল নাটক-মিছিলের সুর। জড়িয়েছিল গণনাট্য। 

চল্লিশের দশক ভারতের কাছে এক অদ্ভুত দশক। এই সময় দেশ দেখেছে দুর্ভিক্ষ, দেখেছে বিশাল কৃষক আন্দোলন। জমিদারি, মহাজন ও সরকারি শোষণনীতির বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ আন্দোলনের পাশাপাশি এসেছে স্বাধীনতার আলো। এমন আলো-আঁধারি পরিবেশেই ফুটে উঠল সলিল চৌধুরীর প্রতিভা। ছোটবেলায় আসামের চা বাগানে দেখেছেন চা-শ্রমিকদের। দেখেছেন তাঁদের দুর্দশা। তারপর কলকাতায় এসে সম্মুখীন হলেন এমন আন্দোলনের। কবিতা-সঙ্গীত-সাহিত্য নিয়ে বেড়ে ওঠা সলিল যেন চুপ থাকতে পারলেন না। জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে। কমিউনিস্ট আদর্শ ভেতরে ভেতরে লালিত হচ্ছে। চল্লিশের দশকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও নেমে পড়লেন তিনি… 

১৯৪৩ সাল। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে তৈরি হল একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক সংগঠন। পথ চলা শুরু ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’-এর। উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, সুচিত্রা মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মতো বাংলার সংস্কৃতি জগতের দিকপালরা এই সংগঠনে এসে উপস্থিত হলেন। আর সেখানেই হাজির হলেন সলিল চৌধুরী। শুধু সুর নয়; কবিতা-গল্প-নাটক সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই ওই সময়টাকে ধরতে চাইছেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৪৫ সালে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। বিদ্যাধরীর বন্যায় ভেসে গেল অসংখ্য চাষের জমি। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন কৃষকরা। একে ভাত নেই পেটে, তার ওপর এমন দুর্যোগ! এদিকে প্রশাসনের সাহায্য আসা তো দূর, অত্যাচার আরও বেড়েই চলল। নড়ে গেলেন সলিল । বলা ভালো, এই ঘটনাটাই সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরীকে খাঁচা থেকে মুক্তি দিল। ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’, ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’-এর মতো একের পর এক গানে ভেসে যাচ্ছে বাংলার সমাজ। ভেসে যাচ্ছে গণসঙ্গীত। 

তখনও গণনাট্য সংঘের কাজ, সেই সুর নিয়েই মেতে আছেন সলিল চৌধুরী। সেই সূত্রেই কয়েকটি গান নিয়ে গেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গণনাট্যে তখনও যুক্ত হননি হেমন্ত। কাজেই সেইসব গান করতে রাজি হলেন না তিনি। সলিল চৌধুরী খানিক আশাহত। বাড়ি ফেরার জন্য বেরিয়েছেন; হঠাৎই মাথায় খেলে গেল কয়েকটি লাইন। কবিতাটা কয়েকদিন আগেই লিখেছিলেন। সম্পূর্ণ হয়নি; কিন্তু সেখানেই যেন একটা সুর বাজছে! সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন হেমন্ত’র কাছে। তাঁর কাছে উপুড় করলেন খাতা। অর্ধেক লেখা গানটিতেই সুর দিলেন সেখানে বসে। হেমন্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এ কি শুনলেন! সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন রেকর্ডিং করতে। বাড়ি গিয়ে ওই কবিতাটিও পুরো করলেন সলিল চৌধুরী। জন্ম নিল ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। জন্ম নিল একটি মিথ। জন্ম নিলেন সলিল… 

বস্তুত এরপরই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গণনাট্যে আসেন। সঙ্গে আসেন দেবব্রত বিশ্বাসও। সালটা ১৯৪৮। জমজমাট গণনাট্য। তার মধ্যেই সুরে তাল কাটল। সলিল চৌধুরীর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী প্রয়াত হলেন। সেইসঙ্গে বদল হল পার্টির প্রধান নেতা। যে গান সলিল চৌধুরীর প্রাণের অঙ্গ ছিল, যে লেখা আর সুরের মধ্যে দিয়ে একটা নতুন ছবি ফুটে উঠছিল, সেটাই বন্ধ হয়ে গেল। বলা হল, পার্টির অনুমোদন ছাড়া সলিল চৌধুরী প্রকাশ্যে গান গাইতে পারবেন না! এটা কেমন ফতোয়া! কী করবেন এবার? গান, কবিতা এসব ছাড়া যে তিনি অচল। পেটের টান যে বড়ো টান। টুকটাক গল্পও লিখেছেন তখন। তারই একটি গল্প ‘রিক্সাওয়ালা’র দিকে নজর পড়ল বিমল রায়ের। মুম্বইতে ডেকে নিলেন সলিলকে। শুরু হল নতুন এক আখ্যান। ‘রিক্সাওয়ালা’ অবলম্বনে বিমল রায় তৈরি করলেন ‘দো বিঘা জমিন’। চিত্রনাট্যকার সলিল চৌধুরী এখানেই অবতীর্ণ হলেন সুরকার হিসেবে… 

আরও পড়ুন
মাইকেলের সনেটে সুর দিলেন সলিল চৌধুরী, গাইলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

বাকিটা? বাকিটা তো এক কিংবদন্তির যাত্রার গল্প। যার হাত ধরে নতুন রূপ পেল ভারতের সঙ্গীতজগত। সলিল চৌধুরীর হাত ধরে যেন দিগন্ত খুলে গেল। তৈরি হল এক একটি রূপকথা। ‘আনন্দ’ ছবির কাজ চলছে। একের পর এক অবিস্মরণীয় গান। রাজেশ খান্না আর অমিতাভ বচ্চন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। হঠাৎই এক জায়গায় থমকে গেলেন রাজেশ খান্না। ব্যাকগ্রাউন্ড সং হিসেবে একটি বিশেষ গানকে বেছেছেন সলিল চৌধুরী। এমন একটি গানকে স্রেফ আবহ সঙ্গীত করে ছেড়ে দেওয়া হবে? কিছুতেই হবে না। রাজেশ খান্না জানালেন, তিনি নিজে লিপ দেবেন এমন গানে। গানটি ছিল ‘জিন্দেগি ক্যায়সে হ্যায় পহেলি’… 

ছোটো থেকেই অন্ধ সলিল-ভক্ত রাহুল দেববর্মণ। কিছুতেই পছন্দ হয় না বাবা শচীন দেববর্মণের সুর। মহা বিপদে পড়েছেন শচীনকর্তা! একদিন এলেন সলিল চৌধুরীর কাছে। রীতিমতো অনুরোধ করে পঞ্চমকে একটু বোঝাতে বললেন। সলিল বললে হয়তো শুনবে ‘পোলাডা’। এমনই ছিল সলিলের জাদু। আরও কত কাহিনি ছড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু যে রাস্তায় শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা, তাঁকে ভুলতে পেরেছিলেন কি? গণনাট্যে না থাকলেও, সলিল চৌধুরীর ভেতর থেকে তো ‘গণনাট্য’ মুছে যায়নি। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য, কৃষক-মজদুরের জন্য নিজের সুরকেই হাতিয়ার করে গেছেন বারবার। আজও বাংলার অলিন্দে বেজে ওঠে ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’। সলিল যাননি। তিনি যেতে পারেন না… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে…’, মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা
২) ‘সলিলের সঙ্গে নদিয়ার যোগসূত্র স্থাপন গণনাট্যের মাধ্যমেই’, দেবোত্তম চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক সলিল’, সবিতা চৌধুরী, অনুলিখন- কৃশানু ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা

আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা

Powered by Froala Editor

More From Author See More