ত্রিকোণ প্রেম থেকে খুন; এশিয়ার বুকে প্রথম ডিএনএ পরীক্ষার প্রথম প্রয়োগ কলকাতাতেই

সালটা ১৮৮৭। গোয়েন্দা গল্পের জগতে সূচনা হলো এক নবযুগের। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের হাত ধরে অপরাধ জগতের তথ্য-তালাশ খুঁজে বের করার জন্য আবির্ভাব ঘটল শার্লক হোমসের। হোমস তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির উপর ভর করে একের পর এক অপরাধীকে পাকড়াও করেছেন। ক্লু বলতে কখনো পোড়া সিগারেটের টুকরো অথবা পায়ের ছাপ। ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের প্রথম পর্যন্ত রহস্যপ্রেমীদের নয়নের মনি হয়ে ওঠেন শার্লক। আমাদের আজকের এই গল্পটা কল্পনার শার্লক হোমসকে নিয়ে নয় বরং বাস্তবের হোমসদের নিয়ে।

২০১১ সালের ২০ জুন। সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি ভিজছে কল্লোলিনী তিলোত্তমা। বৃষ্টিভেজা রাত আর নিয়ন আলোর রোশনাই এই দুইয়ের যুগলবন্দি ক্রমাগত আরও সুন্দরী করে তুলছে 'সিটি অফ জয়'-কে। এই রাতের অন্ধকার চিরে সল্টলেকের প্রশস্ত রাজপথ ধরে মসৃণ গতিতে ছুটে চলেছিল একটি হন্ডা সিটি গাড়ি। গাড়ির সওয়ারি ড্রাইভার সালাউদ্দিন এবং ভি আই পি রোডের একটি পানশালার কর্মী অজয় সেন ওরফে বাপি। সেদিনের সেই মায়াবী রাতে গাড়ির মধ্যেই বোধহয় ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর ছিল সালাউদ্দিন। নতুন জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে শুরু করছিল নবজীবন শুরুর পরিকল্পনা। কিন্তু গাড়ির অন্য এক যাত্রী বাপির মাথায় ঘুরছিল নৃশংস এক পরিকল্পনা। 

ইতিমধ্যে গাড়ি পৌঁছে গেছে সল্টলেকের আট নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে। নিশ্চিন্ত মনে সিগারেটে সুখটান দিতে মগ্ন বাপি। হঠাৎ করেই বাথরুমের অছিলায় সালাউদ্দিনকে গাড়ি থামাতে বলল বাপি। সালাউদ্দিন গাড়ি থামালে কল্লোলিনী তিলোত্তমার রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে শোনা গেল গুলির শব্দ। তারপর? গাড়ি থেকে কর্পূরের মতো বেমালুম উধাও বাপি সেন। 

এরপরের ঘটনাটুকু যথেষ্ট মর্মান্তিক। সেদিন রাতে বাপি ওরফে অজয় সেন সালাউদ্দিনকে গুলি করার পর তাকে মৃত ভেবে পালিয়ে যায়। কিন্তু নাটকের তখনও বাকি ছিল,গুলি খেয়েও মরেননি সালাউদ্দিন। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই আরও বেশ কিছুটা গাড়ি চালানোর পর সেরেস্তার কাছে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সালাউদ্দিন। 

রাতের পেট্রলিং ভ্যান থেকে খবর পৌঁছল লালবাজারে। তদন্তে নামলেন হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা। অন্যদিকে খবর চাপা নেই - অবধারিত ভাবে মিডিয়া প্রশ্ন তুলতে শুরু করল রাতের শহরের নিরাপত্তা নিয়ে। 

তদন্তে নেমেই সালাউদ্দিনের গাড়ির প্রতিটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন গোয়েন্দারা। কিন্তু তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো কোনো সূত্র নজরে পড়ল না তাঁদের। এমন সময় তৎকালীন সময়ে এক জুনিয়র অফিসারের চোখে পড়ল, ড্রাইভার সিটের পাশে পড়ে রয়েছে একটি পোড়া সিগারেটের টুকরো। ঘটনাচক্রে পরবর্তীকালে এই পোড়া সিগারেটের টুকরোই তদন্তকারীদের পৌঁছে দেয় অপরাধী পর্যন্ত। 

আরও পড়ুন
পরপর পাঁচজনকে নৃশংস খুন, কলকাতার প্রথম সিরিয়াল কিলার এক মহিলা!

ক্লু বলতে এক টুকরো পোড়া সিগারেট। সেই নিয়েই তখনও অন্ধকারে পথ খুঁজে ফিরছেন লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দারা। ইনফর্ম করা হল প্রায় প্রতিটি খোঁচরকে। এমন সময় এমনই এক সোর্স মারফত লালবাজারে খবর পৌঁছল খুন হবার আগে সেদিন রাতে সালাউদ্দিন বেশ কিছুক্ষণ মদ্যপান করে ভি আই পি রোডের একটি পানশালায়। পোড়খাওয়া অফিসাররা গন্ধ শুঁকে পৌঁছে গেলেন ভি আই পি রোডের সেই পানশালায়। জেরার মুখে পানশালার অন্যান্য কর্মচারীদের মুখ থেকে জানা গেল, সালাউদ্দিন খুনের রাত থেকে বেপাত্তা হয়ে গেছে পানশালার কর্মী অজয় ওরফে বাপি তারই সঙ্গে বেপাত্তা পানশালার এক মহিলা কর্মী মিলি। পানশালার কর্মীদের বয়ানের ভিত্তিতে বীরভূমের মুরারই থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বাপি সেন এবং মিলিকে। 

এতদূর পর্যন্ত কাহিনিতে কোনো বাঁক নেই। গ্রেপ্তার তো করা হল, কিন্তু গোয়েন্দাদের জেরার মুখেও অবিচল বাপি এবং মিলি। তারা কোনো মতেই স্বীকার করতে রাজি নয় তারাই সালাউদ্দিনের খুনি। এখানেই আবার পথ দেখাল সেই পোড়া সিগারেটের টুকরো। ধৃত বাপির রক্তের নমুনা পাঠানো হল কলকাতার ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। বাপির রক্ত এবং সিগারেটের টুকরোর ডিএনএ প্রোফাইল মিলে গেল সম্পূর্ণভাবে। এশিয়ার নিরিখে তিলোত্তমার বুকেই প্রথম ব্যবহৃত হল ডিএনএ পদ্ধতি। সেদিক থেকে এই মামলা উল্লেখযোগ্য অবশ্যই। 

ডিএনএ রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষী প্রমাণিত হল বাপি এবং মিলি। যদিও বাপি আসল হত্যাকারী হলেও, মিলি সম্পূর্ণ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড। জেরার মুখে মিলি স্বীকার করে, ভি আই পি রোডের পানশালায় যাতায়াতের সূত্রেই তার পরিচয় হয় সালাউদ্দিনের সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই পরিচয় গড়ায় প্রেমে। যদিও খুনের কিছুদিন আগে থেকে তাকে এড়িয়ে চলছিলেন সালাউদ্দিন। বদলে অন্য একজনের সঙ্গে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। অতএব ত্রিকোণ প্রেমের পরিণতি শেষ পর্যন্ত মৃত্যু। এমনকি সোনাগাছিতেও অবাধ যাতায়াত ছিল মিলি এবং বাপির, তদন্তে উঠে আসে এমন তথ্যও। 

আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও

২০১১ সালে সালাউদ্দিনের খুনের পর পেরিয়ে গিয়েছে সুদীর্ঘ নয়টি বছর। গতকালই সালাউদ্দিন খুনের মামলার রায় ঘোষণার করেছে কোর্ট। বিচারে বাপি এবং মিলি উভয়কেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে ত্রিকোণ প্রেমের জন্য এই খুন এবং তার তদন্ত হয়তো খুব জটিল ছিল না তদন্তকারীদের কাছে। কিন্তু ডিএনে পরীক্ষার হাত ধরে অপরাধী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে এ এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। 

তথ্যসূত্র - বর্তমান পত্রিকা, ১৬ এবং ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘সবহি কা খুন হ্যায় সামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে,’ প্রতিবাদের ভাষা যুগিয়েছিলেন রাহাত ইন্দোরি

More From Author See More