আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যান্য উৎসবের মতোই সহরায়ও আদ্যন্ত একটি কৃষি উৎসব। তার সঙ্গে এখানে পূজিত হয় গৃহপালিত বা চাষের কাজে সাহায্যকারী পশুরাও। প্রচলিত ধারণায়, কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরের দিন থেকে থেকে শুরু হয় ‘হাতি লেকান সহরায়’; অর্থাৎ হাতির মতো বড় উৎসব সহরায়। নতুন ফসল ঘরে উঠে যাওয়ার পর, পরবর্তী কৃষি মরশুম শুরু হওয়ার প্রস্তুতি পর্বেই আয়োজিত হয় এই পরব। যদিও এখানেও দেখা মেলে গ্রামীন সমাজের তীব্র একাত্মতার। সব গ্রামে একই দিনে শুরু নাও হতে পারে সহরায় পরব। নির্ধারিত সময়ের প্রায় একমাস আগে গ্রামের সকল পুরুষেরা গ্রাম-প্রধান বা ‘মাঝি’র নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে ঠিক করেন পরব শুরুর দিনক্ষণ। গ্রামের একটি পরিবারও যাতে উৎসবের আলো থেকে বাদ না পড়ে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নিরলস ভাবে কাজ করেছেন, সেরকম বেশ কিছু গবেষকের মতে ‘সহরায়’ শব্দের অর্থ হল ‘চুক্তির ভিত্তিতে সমর্পণ’। এই ঘটনার ব্যাখ্যা থেকে আমরা আবার পেয়ে যাই হিন্দুদের অন্যতম বৃহৎ উৎসব কালী পুজো বা দীপাবলির এক ভিন্নতর ভাবনা। এই মতে বলা হয় যে, বহিরাগতরা আদিবাসী সাঁওতালদের পবিত্র ভূমিতে আক্রমণ করলে, সাঁওতালরা এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাস্ত করেন বহিরাগতদের এবং উভয়পক্ষই একটি সন্ধিতে আসতে ইচ্ছুক হন। এই সন্ধির জন্য একটি দীর্ঘ চুক্তিপত্রও প্রস্তুত করা হয়। মিলিত সভায় যখন একেকটি চুক্তিতে সহমত হন উভয়পক্ষই, তখন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একটি করে প্রদীপ বা দিয়া। এই থেকেই দীপাবলি উৎসবের সূচনা বলে ব্যক্ত করা হয় এই মতে। বিভিন্ন সহরায় গীতিতেও পাওয়া যায় এই যুদ্ধের উল্লেখ।
আরও একটি মতে বলা হয়, ‘সহরায়’ শব্দটি এসেছে যাদের মাধ্যমে আদিবাসী মানুষজন জীবিকাটুকু অর্জন করে উঠতে পারছে, তাদের প্রতি সম্মানার্থে। এই মতে, ‘সহর’ শব্দের অর্থ সমৃদ্ধি এবং ‘আয়’ শব্দের অর্থ উপার্জন। এই মতবাদ অনুযায়ী একটা ধারণা পাওয়া যায় যে, কেন এই উৎসবে গাভী, বলদ, অন্যান্য গৃহপালিত পশু বা কৃষি জমির উপাসনা করা হয়।
মোটামুটি ভাবে পাঁচ দিনের উৎসব সহরায়। প্রতিটি দিনের বিশেষ তাৎপর্য এবং আলাদা আচার-অনুষ্ঠান। প্রথম দিনের নাম উম মাহা। দ্বিতীয় দিন সারডি মাহা। তৃতীয় দিন খুন্টাও মাহা। চতুর্থ দিন জালে মাহা এবং পঞ্চম তথা শেষ দিন গাদয় মাহা।
যদিও এই উৎসবের প্রথম দু’দিন মহিলাদের কোনও রকম অংশগ্রহণ থাকে না। প্রথম দিন দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলে, গ্রামবাসীরা গোয়াল থেকে গরুদের বের করে নিয়ে আসেন মাঠে। মাঠের একটি স্থানে রাখা হয় একটি ডিম বা কিছু ধানের অংশ। এরপর সমস্ত গরুকে একসঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয় সেই দিকে। বাজানো হয় তীব্র সপ্তকে ধামসা-মাদল। তাতে উত্তেজিত হয়ে গোরুগুলি ছুটতে শুরু করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। যে গোরুটি ওই ডিম বা ধানের উপর পা ফেলবে, তাকেই নির্ধারণ করা হয় ‘লক্ষ্মী’ বা পবিত্র গরু হিসেবে। অর্থাৎ তার মাধ্যমেই সুখ-সমৃদ্ধি নেমে আসবে গ্রামে। বিশেষ খাতির পান সেই গোরুর মালিকও। উপঢৌকন হিসেবে সেই মালিক এক ঘড়া হাড়িয়া দিয়ে থাকেন গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে। সন্ধে হলে সেই সমস্ত গরুদের নিয়ে ফেরা হয় ঘরে। এ রাত জাগবার রাত। তাই গাওয়া হয় ‘জাগরনী গান’। প্রথম দিন ঢলে পড়ে দ্বিতীয় দিনের দিকে।
দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ সারডি মাহাতে পিতৃপুরুষদের অর্চনার সঙ্গে সঙ্গে পুজো করা হয় গৃহ দেবতা বা কুল দেবতারও। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন, অতিথিরা আসতে থাকেন ঘরে। নাচে, গানে, মহুয়া-হাড়িয়ার নেশায় জমে ওঠে মহল্লা। এরপর পুজোর চাল এবং বলি দেওয়া মুরগির মাথা দিয়ে তৈরি করা হয় একটি বিশেষ উপাদান, যার নাম ‘সোরে’। কেবলমাত্র দেবতাকে ভোগ দেওয়ার জন্যই বানানো হয় এটি।
রাতের বেলায় চাল গুঁড়োর মধ্যে মাংসের টুকরো মিশিয়ে শালপাতা চাপা দিয়ে ঝলসে নেওয়া হয় আগুনের তাপে। মাংস-পিঠা তৈরি হতে হতে চলতে থাকে নাচ-গানও। তার সঙ্গে অধীর অপেক্ষা, পরের দিনের খুন্টাও মাহার জন্য।
তৃতীয় দিন বা খুন্টাও মাহা সহরায় পরবের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি ‘গরু খুঁটা’ বা কোথাও কোথাও ‘বাঁদনা’ নামেও পরিচিত। এই দিন নিয়ম-আচার শুরু হয় সকাল থেকেই। গ্রাম প্রধান এবং নাইকের থেকে অনুমতি নিয়ে শুরু হয় পূজা কর্ম। ‘গরু খুঁটা’ হল আসলে গৃহপালিত গরুগুলিকে এবং ‘কাঁড়া খুঁটা’ হল চাষের কাজে ব্যবহৃত বলদগুলিকে উত্যক্ত করা। মনে করা হয় যে বর্ষাকালে চাষবাসের পর মাঠে ফসল থাকার জন্য দীর্ঘদিন অলস হয়ে পড়ে থাকতে হয় এই পশুগুলিকে। তাই শীতকালীন চাষবাস শুরু হবার আগে এদের শারীরিক ভাবে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে আসার জন্যই এই পদ্ধতি নেওয়া হয়।
এই দিন সকালে আমন্ত্রিত মেয়ে বা বোনের স্বামীকে একটি নতুন কাপড় (সাধারণত ধুতি) উপহার দেওয়া হয় মেয়ের বাড়ির তরফে এবং তাঁকে অনুরোধ করা হয় শাল গাছের গুঁড়িটি দাঁড় করানোর জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজ শুরু করতে। গরু খুঁটা অনুষ্ঠানের পর কোনও কোনও গ্রামে শুরু হয় পুরুষদের ব্যক্তিগত কোনও দক্ষতা দেখানোর খেলা। গ্রাম প্রধানের ডাকে এগিয়ে এসে হাতে লাঠি তুলে নিলে, যেন বিদ্যুত চমকে ওঠে তার ঘূর্ণিতে। সন্ধে যত রাত্রির দিকে এগিয়ে চলে, উৎসবের রেশ বাড়তে থাকে ততই।
উৎসবের চতুর্থ দিন জালে মাহা। সাধারণত এই দিন গ্রামের যুবকেরা গ্রামের মধ্যেই নাচ-গান করতে করতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যায় এবং সংগ্রহ করে নুন ধান হাড়িয়া ইত্যাদি। আগেকার দিনে এই সমস্ত উপকরণ তারা জমা দিতে যুগ-মাঝির ঘরে এবং তারপর সকলে মিলে মেতে উঠতো গ্রামীণ পিকনিকে। যদিও সেই পরম্পরা এখন ফিকে হতে হতে মিলিয়েই যেতে বসেছে প্রায়। তবে এক্ষেত্রে এক্ষুনি যে ‘যুগ-মাঝি’র কথা বলা হল, তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উৎসবের পঞ্চম দিন, অর্থাৎ গাদয় মাহাতে।
সাঁওতালি সম্প্রদায়ের পরম্পরা অনুযায়ী সহরায় পরবের শেষ তিনদিন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা স্বাধীন ভাবে মেলামেশা করতে পারে। কিন্তু এর মধ্যেও ছেলেমেয়েরা যাতে এমন কিছু করে না বসে, যা সাঁওতাল সমাজের পরম্পরা বিরোধী, সেটা দেখাই হল যুগ-মাঝির কাজ। গ্রামের পাঁচজন প্রধান ব্যক্তির মধ্যে থেকে যুগ-মাঝি নির্বাচিত হন। উৎসবের শেষ দিনে যুগ-মাঝি গ্রামের ছেলেমেয়েদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণা করেন উৎসবের।
এই প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা উচিত সহরায় পরবের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেটি হল দেয়ালচিত্র বা ওয়াল পেইন্টিং। মূলত বাড়ির মহিলারাই এই অপূর্ব দেয়ালচিত্রগুলি এঁকে থাকেন কোনওরকম তথাকথিত প্রশিক্ষণ ছাড়াই। এই ছবিগুলিতে কোনওরকম কৃত্রিম রংও ব্যবহার হয় না। সে সামর্থ্যই বা কোথায়! তাই রং খুঁজে নিতে হয় প্রকৃতির মধ্যে থেকেই। তবে উৎসবের মরশুমে শুধুমাত্র ঘরবাড়ি সুন্দর দেখানোই যে এর উদ্দেশ্য, তা কিন্তু একদমই নয়। বরং এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল, গত বর্ষায় ঘরবাড়ির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা মেরামত করা এবং আগামী বর্ষার ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে ঘরকে রক্ষা করা।
এই সব ছবি আর থাকবে না এই সব উৎসব অনুষ্ঠানগুলিকে সর্বগ্রাসী আধুনিক সংস্কৃতি গিলে ফেললে। থাকবে না লাগড়ে, দং, পাতা বা বাহার মতো আরও নানা রকম প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকা সেরেঞ বা গান অথবা হাতে হাত ধরে ঢেউয়ের মতো বয়ে চলা নাচ। মাথার উপর কার্তিকের চাঁদ উঠেছে পুরুলিয়ার দূষণহীন পরিষ্কার আকাশে। দু’পাশে নেমে গেছে এবড়োখেবড়ো জমি। দূরান্তের নক্ষত্রে মিশে যাচ্ছে কেঁপে কেঁপে ওঠা হলুদ সর্ষের ফুল। কেন জানি হঠাৎ মনে পড়ে ধূসর পান্ডুলিপির মতো জীবনানন্দ দাশ :
তাদের মাটির গল্প— তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি—
তুমি জান— এ- পৃথিবী আজ জানে তা কি!