‘সাগরের মৃত্যু নেই, সে অমর’, সাগর সেনের অকালপ্রয়াণে লিখেছিলেন সুচিত্রা মিত্র

বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গান। বিগত শতকের গোড়ার দিকে পঙ্কজ কুমার মল্লিক রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার যে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের বিভিন্ন শিল্পীরা বিভিন্ন সময়ে সেই দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, পঙ্কজ-প্রবর্তিত পথেই হেটেছেন তাঁরা নিজের যোগ্যতায় এবং আপন ভঙ্গিমায়। এবং এইভাবেই রবীন্দ্রগান হয়ে উঠেছে বাংলার প্রতিটি ঘরের সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী। সকাল-সাঁঝে কাজের মাঝে অনেকেই নিজ নিজ প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে ঢেলে নিতে চান। আবার অনেক সময় বেতার বা বর্তমান যুগের নিত্যসঙ্গী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ঠিক কানে চলে আসে বিভিন্ন গান, রবীন্দ্রসঙ্গীতও। 

এইভাবেই একদিন কী যেন এক কাজের মাঝে কানে এল মার্জিত শ্রুতিমধুর কণ্ঠে গীত একটি গান - ‘তুমি এ-পার ও-পার করো কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে?’ ইতিপূর্বে গানটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না একেবারেই। খানিকটা হয়তো সেই কণ্ঠের আকর্ষণেই কান পেতে ভালো করে শুনতে থাকি অপূর্ব সেই গান। ‘কালো জলের কলকলে আঁখি আমার ছলচলে/ও পার হতে সোনার আভা পরান ফেলে ছেয়ে।/দেখি তোমার মুখে কথাটি নাই ওগো খেয়ার নেয়ে--/কী যে তোমার চোখে লেখা আছে দেখি যে সব চেয়ে…’ – এই অংশটুকু শুনে মনটা হঠাৎ যেন হু হু করে উঠল। গানের ভেতর দিয়েও কারুর চোখে অমন করে তাকানো যায়? 

প্রয়াণের আটত্রিশ বছর পরও এইভাবেই আকৃষ্ট করতে পারেন তিনি। বিমুগ্ধ শ্রোতারা আজও অবাক হয়ে শোনেন তাঁর কণ্ঠ। তিনি বাংলা সঙ্গীতজগতের এক বিস্ময়কর প্রতিভা সাগর সেন। 

পূর্বতন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার প্রখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিজনবিহারী সেন ও নয়নমঞ্জরী সেনের কনিষ্ঠ পুত্র সাগর সেন। তবে তাঁর জন্ম হয়েছিল কলকাতায় ১৯৩২ সালের ১৫ মে। স্থানান্তরের পরবর্তীতেও দেশের বাড়িতে বহুদিন ধরে তাঁর যাতায়াত ছিল অব্যাহত। অনেকেরই ধারণা তাঁর জন্ম বরানগরে মামারবাড়িতে। কিন্তু তা সঠিক নয়। শৈশবকাল বাংলাদেশে কাটলেও তাঁর প্রায় আড়াই দশকের সঙ্গীতজীবন কেটেছে কলকাতাতেই। 

ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রকৃতিদত্ত কণ্ঠের অধিকারী। সেই কণ্ঠকেই ধীরে ধীরে পরিশীলিত, পরিমার্জিত করে তুলেছিলেন তিনি নিজের চেষ্টায় ও দক্ষতায়। সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখেননি কারুর কাছেই। তা সত্ত্বেও আশ্চর্যভাবে অদৃষ্টের বিধানেই হয়তো সঙ্গীতই ছিল তাঁর সারাজীবনের মূল সঙ্গী, আমাদের কাছে তা পরম সৌভাগ্য। তীর্থপতি ইন্সটিটিউশনে স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। এরপরে পাবলিক ফাংশনের মাধ্যমে শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হওয়া এবং ১৯৫৮ সালে প্রথম বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন। এইভাবেই তাঁর সঙ্গীতজীবনের সূত্রপাত ঘটে। 

আরও পড়ুন
‘তুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতটা হইব না’, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বললেন দেবব্রত

সঙ্গীতজীবনের প্রথম থেকেই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর কণ্ঠের অসামান্য ব্যাপ্তি ও গভীরতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় এবং ভাবের জটিলতম মিশ্রণের অনায়াসসাধ্য পরিবেশনাতে অত্যন্ত সফল ছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড; গানদুটি ছিল ‘ওগো জলের রাণী’ এবং ‘নূপুর বেজে যায়’। এর এক বছরের মধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র ‘রবিরশ্মি’। অচিরেই ‘রবিরশ্মি’র নথিভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করে এবং তাঁর অনুগামীদের সংখ্যাও বেড়ে ওঠে ক্রমশঃ। ঐ একই বছর তিনি সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর প্রথম সন্তান প্রীতম সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৪ সালে। ওই একই বছর তাঁর গাওয়া 'আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না' এবং 'কেন আমায় পাগল করে যাস' প্রকাশিত হয় কলম্বিয়া রেকর্ড লেবেলে। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র প্রিয়ম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৬-তে এবং তার পরের বছরই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রমিত সেনের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালেই কলম্বিয়া রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি রেকর্ড, যার গানদুটি ছিল 'ওই মালতীলতা দোলে' এবং 'আমার নয়ন তব নয়নের'।

১৯৬৮ সাল হল সাগর সেনের সঙ্গীতজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বছর। সে'বছর গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর কণ্ঠে 'সখী বহে গেলো বেলা' এবং 'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান' -  রবীন্দ্রনাথের 'মায়ার খেলা' নাটকের গান। 'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান'- গানটি সাগর সেনকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এইভাবেই 'রবিরশ্মি'-'র প্রতিষ্ঠাতা সাগর সেন হয়ে উঠলেন এক সচল প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ঈপ্সিত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতানুরাগী মানুষদের কাছে; জন্ম হল এক কিংবদন্তির।

আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা

এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই সাগর সেনের রেকর্ড প্রকাশিত হতে থাকে। ১২টি গান নিয়ে তাঁর প্রথম স্টিরিওফোনিক এল পি রেকর্ড প্রকাশিত হয় ইএমআই-এইচএমভি রেকর্ড লেবেলে ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৯ সালে 'পরিচয়' ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে' গানটির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্যকণ্ঠশিল্পী হিসেবে 'বিএফজেএ' পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ছায়াছবির জগতে তিনিই প্রথম পুরুষ শিল্পী, যিনি ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাঁর স্বল্পায়ু সঙ্গীতজীবনে তিনি প্রায় ১০০টি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন, যেগুলি প্রায় আড়াই দশক ধরে প্রকাশিত হয়েছে মেগাফোন, কলম্বিয়া, এইচএমভি রেকর্ড লেবেলে। এহেন একজন কিংবদন্তি শিল্পীর বহু অসামান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত সেইসময়ে আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হত যেগুলি এখন 'প্রসার ভারতী আর্কাইভ'-এ সংরক্ষিত আছে। তিনি ছিলেন বেতারের নিয়মিত শিল্পী। ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও’ ইত্যাদি গান তিনি বেতারে পরিবেশন করেছেন বিভিন্ন সময় যেগুলি কোম্পানি-প্রকাশিত বাণিজ্যিক রেকর্ডে পাওয়া যায় না। 


১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে দূরদর্শনের সূচনাপর্বে সাগর সেনের একক কণ্ঠে পাঠ ও দ্বৈত-কণ্ঠে সুমিত্রা সেনের সঙ্গে 'আজি এ আনন্দসন্ধ্যা' গানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা দূরদর্শনের পর্দায়। পরবর্তীতে দূরদর্শনেও বহু অনুষ্ঠান করেছেন তিনি যার মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘রবিরশ্মি’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি একক কণ্ঠে পরিবেশন করেছিলেন দুটি বর্ষার গান- ‘এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও’ ও ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি’। এছাড়াও একটি সিটিং-এ গেয়েছিলেন তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আকাশভরা সূর্য তারা’, ‘জীবনে আমার যত আনন্দ’ এবং ‘ওই ঝঞ্ঝার ঝংকারে ঝংকারে’। অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। 

আরও পড়ুন
পান্নালাল ভট্টাচার্যকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলিয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়

অনন্য উপলব্ধি এবং আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি তাঁর রেকর্ড করা প্রতিটি রবীন্দ্রসঙ্গীতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বহু অপ্রচলিত রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার জনমানসে। বিভিন্ন গীতিনাট্যে কণ্ঠদান তো বটেই, নির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে সংকলিত মঞ্চানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম পথপ্রদর্শক। এই অনুষ্ঠানগুলির পরিকল্পনা, পরিচালনা ও নির্দেশনায় থাকতেন সাগর সেন নিজেই। সেইসব অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে 'শ্রাবণসন্ধ্যা', 'বিশ্বজন মোহিছে', 'গানের ঝর্ণাতলায়', 'স্বদেশী নেয়ে বিদেশী খেয়া', 'ঋতুরঙ্গ' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে 'শ্রাবণসন্ধ্যা' বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল এবং এই অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ তাবড়-তাবড় শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতেন। এই মঞ্চানুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে নবপ্রজন্মের বহু সঙ্গীত এবং নৃত্যশিল্পীদের তিনি প্রতিভা প্রকাশের যোগ্য সুযোগ দিতেন। সমকালীন সময়ে সাগর সেন ছিলেন এক বিস্ময়কর মঞ্চায়োজক।


সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও সাগর সেন ছিলেন একজন প্রতিভাবান ভাস্কর। কিশোর বয়সেই দেশের বাড়ির একচালা দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতেন একা হাতে। ভবানীপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ির দুর্গাপূজায় টানা আধঘণ্টা-একঘণ্টা ঢাক বাজাতে পরিবারের অনেকেই দেখেছেন তাঁকে। এছাড়া খুব ভালো ছবিও আঁকতেন। 

আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে নিজের চোখে দেখেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!

একজন আদর্শ সঙ্গীতশিল্পীর সমস্ত গুণই ছিল তাঁর মধ্যে বর্তমান। অত্যন্ত নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতেন তিনি। নিয়মিত সকালে উঠে রেওয়াজে বসতেন। অতি মশলাদার বা ঠান্ডা জিনিস খেতেন না একেবারেই। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় খাবার ছিল চিংড়িমাছ ও খাঁটি ইলিশ। শুধুমাত্র কণ্ঠের যত্নের কথা মাথায় রেখে এইসব খাবার ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সময়জ্ঞানও ছিল অত্যন্ত প্রখর। তাঁকে দিয়ে ঘড়ির সময় মেলানো যেত। হাজার ঝড়-জল-বৃষ্টিতেও পূর্ব-নির্ধারিত সময়েই শুরু করতেন প্রতিবারের ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান। এছাড়া বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ধরণের গান শোনার শখ ছিল তাঁর। ইংরেজি, গ্রিক, জার্মান ইত্যাদি ভাষার গানও শুনতেন এবং চিন্তা করতেন কীভাবে সেই সঙ্গীতশৈলী সুচিন্তিত, সাবলীল এবং মার্জিতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রয়োগ করা যায়। সেই কারণেই হয়তো তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের যন্ত্রানুসঙ্গের পরিচালনার ভার নিশ্চিন্তে রাখতে পেরেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের হাতে। অনেকের কাছেই এ'কথা অজানা যে সাগর সেনের গাওয়া বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের যন্ত্রানুসঙ্গ দেবব্রত বিশ্বাসের করা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আশ্চর্যরকমের নিরীক্ষা করেছিলেন তিনি, যা সমসাময়িককালে অত্যন্ত আধুনিকতার দাবি রেখেছিল।

সাগর সেন শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিভাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত-পরামর্শদাতা, আয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন মানবদরদী মানুষ। নিজের আয়োজিত বহু চ্যারিটেবেল পাবলিক ফাংশনের মাধ্যমে তিনি অক্লান্তভাবে জনহিতকর কাজের প্রেক্ষিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, বিশেষ করে সত্তরের দশকের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে তিনি বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কত মানুষকে নিঃশব্দে কত দান করেছেন তিনি, পরিবারের কাউকে কখনও জানতে দেননি। তাঁর বহু ছাত্র ও অসংখ্য অনুরাগীদের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বরতুল্য মানুষ, একজন পথ-প্রদর্শক, একজন অভিভাবক, একজন পরহিতব্রতী ব্যক্তিত্ব, তাদের প্রিয় 'সাগরদা'! 

যে যেখানে দাঁড়িয়ে(১৯৭৪), মন্ত্রমুগ্ধ(১৯৭৭), আবির্ভাব(রেকর্ড প্রকাশ ১৯৭৮-তে), পরিচয়(১৯৭৯), পাকাদেখা(১৯৮০),  মা কল্যাণেশ্বরী (১৯৮২), দেবীকা (১৯৮৫) ইত্যাদি ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অগ্রগণ্য সুরকারদের সুরে নেপথ্যসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। হয়ত অনেকেরই অজানা, 'আবির্ভাব' ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সাগর সেন নিজে। ছবিটি অন্যনামে মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে; তবে রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এছাড়াও আরো দুটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন তিনি, যেগুলি মুক্তি পায়নি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, হৈমন্তী শুক্লা, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী প্রমুখ সাগর সেনের সুরে গান করেছেন। 


সঙ্গীতজীবনের শেষ পর্যায়ে সাগর সেন আধুনিক গান রেকর্ড করা শুরু করেন। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত সলিল চৌধুরীর সুরে 'কি হল চাঁদ কেন মেঘে ঢেকে গেলো' এবং 'এ জীবন এমনি করে আর তো সয় না' এখনও বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কণ্ঠে আরও দুটি আধুনিক গান; একটি বিশ্বনাথ দাসের কথায় ‘তোমার জন্য সবটুকু সুখ’ এবং অপরটি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘এ জীবন সূর্যের স্বপ্ন’; দুটি গানেই সুর দিয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও আকাশবাণী আর্কাইভে তাঁর গাওয়া বেশকিছু আধুনিক গান সংরক্ষিত রয়েছে, যার মধ্যে ইন্দিরা দেবীর কথায় ও বিমান ঘোষের সুরে ‘তোমার আকার নাই কি কোনো’, অরবিন্দ ভট্টাচার্যর কথায় ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘বন্ধু রে, যাবি কতদূর’, অনিল ভট্টাচার্যর কথায় ও বিমান ঘোষের সুরে ‘আমি গেঁথেছি বকুলমালা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীনই তিনি ভয়াবহ কর্কট রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যেও অদম্য উদ্যমে পাব্লিক ফাংশন ও গানের রেকর্ডিং করেছেন তিনি। কিন্তু এক সময় ব্যাধি তাঁকে গ্রাস করে দুর্দান্তভাবে। প্রায় দেড় বছর লড়াইয়ের পর এক বিস্ময়কর সঙ্গীতজীবন হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে, ১৯৮৩ সালের ৪ জানুয়ারি এই অসামান্য সঙ্গীতপ্রতিভা সুরলোকে গমন করেন। তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তীকালে প্রকাশিত ‘আর কত দূরে’ শীর্ষক লং প্লেয়িং রেকর্ড-কভারে রবীন্দ্রসঙ্গীতজগতের রাজেন্দ্রাণী সুচিত্রা মিত্রর রচনার অংশবিশেষটুকুই হোক এই নিবন্ধের আদর্শ উপসংহার-

“বলিষ্ঠ-উদার-ভাবময় কণ্ঠের অধিকারী সাগর সেন অবলীলাক্রমে রবীন্দ্রনাথের অফুরন্ত গানের অতল সমুদ্রে অবগাহন করে যে মণিমাণিক্য কুড়িয়ে এনেছিল তা-ই ছড়িয়ে দিয়েছিল অগণিত শ্রোতার মনোজগতে। তখন গান আর শুধু গানই থাকেনি – হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে এক অপরিহার্য পাথেয়। তাঁর কণ্ঠে একই সঙ্গে রঙের জাল বুনে যেত বলিষ্ঠতা-স্নিগ্ধতা-দরদ-সংযম – আর এসব মিলিয়ে এক প্রসর প্রশান্তি মূর্ত হয়ে উঠত। সাগরের আত্মপ্রত্যয়, অবিচলিত নিষ্ঠা, রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে অবিমিশ্র শ্রদ্ধা তাঁকে অচিরেই জনমানসে একটি কালজয়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সাগরের মৃত্যু নেই। সে অমর।” 

শিল্পীর জীবনের বহুতথ্য তাঁর পরিবারের সূত্রে প্রাপ্ত।
চিত্র সৌজন্যেঃ www.sagarsen.org
বিশেষ সহযোগিতাঃ তন্ময় দাস

Powered by Froala Editor

More From Author See More