১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি। বর্ষবরণের আনন্দে মেতে উঠেছে পৃথিবী। বাদ নেই আমাদের ভারতও। কিন্তু তার মধ্যেই যেন নতুন কিছু শুরু হল দিল্লির রাস্তায়। একটু দূরে, শাহিদাবাদের ঝান্ডাপুর গ্রামে শুরু হয়েছে পথনাটিকা। নাটকের নাম ‘হাল্লা বোল’। নাট্যদল ‘জনম-এর সদস্য-অভিনেতারা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরতে শুরু করেছিল। তাঁদের অধিকারের দাবি জানাতেই এমন পথনাটিকার আয়োজন। হঠাৎ সেই নাটকের দলের ওপর চড়াও হল একদল লোক।
তাঁরা কেউই যে ‘শান্তির মেজাজে’ ছিল না, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। এসেই শুরু হল তুমুল মারধোর। আর তাঁদের মাঝখানেই পড়ে গেলেন বছর চৌত্রিশের এক তরতাজা যুবক, সফদর হাশমি। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, তীক্ষ্ণ মুখ। অযাচিত হামলায় গুরুতর আহত হলেন তিনি। সফদরের রক্তাক্ত দেহ নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন তাঁর স্ত্রী, মলয়শ্রী এবং নাট্যদলের সদস্যরা। বর্ষবরণের আনন্দ ফিকে পড়ে গেল এক লহমায়। হাসপাতালে পৌঁছলেন বটে, কিন্তু কাজের কাজটি হল না। পরের দিনই চিরকালের মতো থেমে গেল নাট্যশিল্পী সফদর হাশমির প্রতিবাদ, তাঁর চেতনা। থেমে গেল বলিষ্ঠ একটি আওয়াজ…
ভারতের নাট্য ইতিহাসের দুটি দিক বর্তমান। প্রথমটি অবশ্যই পেশাদার রঙ্গমঞ্চের নাটক। আর দ্বিতীয়টি হল পথনাটিকা। বড়ো মঞ্চ, ঠান্ডা ঘরের আবডাল থেকে নাটকের বিষয়কে সরাসরি রাস্তায় নিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু মানুষ। মানুষের কথা, কৃষক-মজুরের কথা, তাঁদের দাবির কথা তুলে ধরার জন্য রাস্তাই হয়ে উঠেছিল জীবনের রঙ্গমঞ্চ। উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটকের মতো মানুষেরা প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন পথনাটিকাকে। আর তাঁদেরই উত্তরসূরি সফদর হাশমি। যার হাত ধরে পথনাটিকা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মুক্তমঞ্চ।
যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিলেন সফদর। সেন্ট স্টিফেনস কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র ছিলেন তিনি। সহজেই কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারতেন। তাতে অর্থের অভাব হত না। আর এই মানসিকতার বিরুদ্ধেই বারবার কথা বলেছেন তিনি। তাঁর শিক্ষা, তাঁর সমাজচেতনা, রাজনীতি তাঁকে নিয়ে এল মানুষের মধ্যে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল দেশের পরিস্থিতি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে জড়িয়ে পড়াও ছাত্র বয়সেই। মঞ্চে নাটক দেখানোর সামর্থ্য নেই সফদর হাশমির। তাছাড়া, ওই চার দেওয়ালে ঘেরা জায়গায় কতজনই বা আসবেন। কতজনই বা শুনবে তাঁদের কথা। সেই যে তিনি বেরিয়ে এলেন পথে, আর ফিরলেন না।
সত্তরের দশক। এই সময় ভারত যেমন দেখেছে নকশাল আন্দোলন, তেমনই দেখেছে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের জারি করা জরুরি অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতেই জন্ম হল ‘জনম’-এর। সফদর হাশমির এই নাট্যদলটি নিজেদের নাটক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সফদর যুক্ত হলেন সমমনস্ক আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তৈরি হল ‘জননাট্য মঞ্চ’-এর। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ভারতীয় শিল্পজগত ও জনতার নজর কেড়ে নিল জনম। ‘কুর্সি, কুর্সি, কুর্সি’ পথনাটিকটি প্রায় প্রতিদিনই আয়োজিত হতে লাগল। এবং এই নাটকটিই মোড় ঘুরিয়ে দিল সফদর হাশমির। বলা ভালো, আওয়াজ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
‘গাঁও সে শহর তক’, ‘তিন ক্রোড়’, ‘অওরাত’— একের পর এক নাটক দেখতে শুরু করল ভারত। তবে তার জন্য টিকিট কাটার দরকার নেই। সফদর হাশমি এবং তাঁর ‘জনম’ যেখানে যেখানে গেল, ভিড় তৈরি হতে শুরু করল। নাটক এভাবে এত কাছে আগে কখনও আসেনি। গোটা ভারতে পথনাটিকাকে ছড়িয়ে দিলেন সফদর। সেইসঙ্গে তুলে ধরলেন প্রতিবাদের মন্ত্র ‘হাল্লা বোল’। সাম্প্রতিকে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ছাত্র আন্দোলন, জেএনইউ— সমস্ত জায়গায় তরুণ সমাজের মুখে মুখে ঘুরেছে এই আওয়াজ। যার সূচনাটা করেছিলেন সফদর হাশমিই। জীবনে ২৪টি পথনাটিকা লিখেছিলেন; আর প্রায় চার হাজার সেইসন নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। কখনও বস্তিতে, কখনও কারখানায় চলে গিয়েছিলেন স্রেফ এইটা জানানোর জন্য যে— আমরাও আছি!
আরও পড়ুন
লকডাউনে বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে ডিজিটাল থিয়েটার
তাঁরা সত্যিই ছিলেন। ছিলেন সফদর হাশমিও। তাই তো ১৯৮৯ সালে তাঁর মৃত্যুর দুদিন পরেই, সেই ঝান্ডাপুরের মাটিতেই পথনাটিকার আয়োজন করেছিলেন সফদরের স্ত্রী, মলয়শ্রী হাশমি। ছিল ‘জনম’ও। ঠিক সেই জায়গা, যেখানে লোহার রড দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল সফদরের। জনম মঞ্চস্থ করল এই একই পথনাটিকা— হাল্লা বোল। এইভাবেই জীবন্ত হয়ে রইলেন সফদর হাশমি। বেঁচে রইল প্রতিবাদ।
তথ্যসূত্র-
১) ‘Street Theatre that changed India: This man gave his life to stand up for what’s right’, Rinchen Norbu Wangchuk, The Better India
২) ‘‘Halla Bol’: Safdar Hashmi’s biography reminds us what it means to be a citizen of democracy’, Sayantan Ghosh, The Scroll
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
হস্তিনানগরীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন একলব্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন পথে