বুকের ওপর মূর্তি রেখে সাধনা; কমলাকান্তের আরাধ্য কালীই বজবজের ‘খুকি’!

ধীরে ধীরে শীত পড়ছে এবার। হোগলাবনের ওপর জমছে কুয়াশার আস্তরণ। তার মধ্যেই ছোট্ট একটি কুটির। গোলপাতার ছাউনি। এক চালা। সেখানেই তপস্যা করছেন এক কালীসাধক। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিথর নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে সেই স্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে পেঁচা, শেয়াল-কুকুরের ডাক। ছড়িয়ে রয়েছে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা আধপোড়া শবদেহ, পোড়া কাঠের গন্ধ।

এমন সময়ই ডাক পড়ল তাঁর। ধ্যান ভাঙতেই টের পেলেন হোগলার ছাউনির ফাঁক থেকেই যেন ঠিকরে ঢুকছে আগুনের আভা। কেউ আগুন জ্বালিয়েছে বাইরে। কিন্তু এই মধ্যরাতে কে এসে হাজির হয়েছে দুয়ারে? মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও রাত্রি বেলায় সচরাচর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে এই শ্মশান চত্বরে আসার সাহস দেখায় না কেউ-ই। তবে? দরজা খুলেই তিনি দেখলেন দু’জন বিশালাকার ছায়ামূর্তি। হাতে জ্বলছে মশাল। আর হাত বিশেক দূর দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার ধারে থমকে আছে বিশমণি নৌকো। তবে যা ভেবেছিলেন তেমনটাই সত্যি? ডাকাতরা এসে হাজির হল দরজায়? কিন্তু এভাবে ডাকল কেন তারা? লুঠ করার ইচ্ছে থাকলে তো পলকা দরমা ভেঙেই ঢুকে পড়তে পারত!

বিষয়টা পরিষ্কার হল খানিক বাদে। ডাকাত সর্দারের গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। পানীয় জলের সন্ধানে তাই কুটির দেখে এই শুনশান প্রান্তরে নৌকা বেঁধেছে তারা। সেই ফাঁকে হয়ে যাবে ভাগ-বাটোয়ারাও। জানা গেল, সুদূর বর্ধমান থেকে লুঠ করে আসছেন তাঁরা। গন্তব্য আরও দক্ষিণের রামকেষ্টপুর। যার বর্তমান নাম কাকদ্বীপ রামকৃষ্ণ নগর। লুঠ-বণ্টনের সময়ই সোনার অলংকার আর দামি থালা-বাসনের মধ্যেই সাধকের চোখে পড়ল চকচক করতে থাকা পাথরের এক মূর্তি। কালীমূর্তি। দৈর্ঘে মাত্র এক হাত। আগ্রহে এগিয়ে এলেন সেই সাধক। ডাকাত-সর্দার কেষ্ট পাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন দেবীকে জল, বাতাসা দিয়েছে কিনা তারা। আর তাতেই শঙ্কা জাগল সর্দারের মনে। তবে কি রুষ্ট হয়েছেন দেবী? তাঁর অভিশাপেই কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি? না, আর সময় নষ্ট করা চলে না। কষ্ঠীপাথরের তৈরি সেই মূর্তি সাধকের কাছে রেখেই চলে ফের পাড়ি দিল ডাকাতরা। আর গঙ্গা তীরবর্তী ছোট্ট কুটিরে জায়গা হল দেবীর। 

যে সময়ের কথা হচ্ছে সেটা ১৮৯২ কি ৯৩ সাল। বজবজে এভাবেই হাজির হয়েছিলেন ‘খুকিমা’। ধীরে ধীরে সেখান থেকেই গড়ে উঠেছে বজ বজ কালীবাড়ি। আর যে সাধকের কথা হচ্ছে। তাঁর নাম দয়াল ঠাকুর। পরবর্তী অমাবস্যাতেই শ্মশানের মাঝে পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী। দয়াল ঠাকুরের গুরু স্বামী পূর্ণানন্দ স্থাপন করেন সেই বিগ্রহ।

তবে সেদিন দয়াল ঠাকুরের আশ্চর্য লেগেছিল অন্য এক জায়গায়। পাথরের তৈরি এই মূর্তি যে চুরি করা আনা হয়েছে কোনো রাজবাড়ি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। তার কারণ বিগ্রহের গঠন। অখণ্ড কষ্ঠীপাথরের তৈরি এই মূর্তি বড়ো কোনো পাথর থেকে কেটে বানানো। এমনকি দেবীর গলার নরমুণ্ডের মালাও খোদাই করে তৈরি। এ যে কোনো সাধারণ শিল্পীর হাতের কাজ হতে পারে না, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। পরে স্বামী পূর্ণানন্দই করেছিলেন সেই রহস্য উদ্ঘাটন।


বজ বজ কালীবাড়ির বিগ্রহ, যিনি পূজিত হতেন কমলাকান্তের কাছে

 

মূর্তিটি ডাকাতি করে আনা হয়েছিল সুদূর বর্ধমান রাজবাড়ি থেকে। তবে রাজবাড়ি বলা ভুল হবে খানিক। রাজবাড়ি সংলগ্ন এক মন্দির থেকেই উঠিয়ে আনা হয়েছিল দেবী বিগ্রহকে। সেখানেই এই মূর্তির পুজো করতেন কালীসাধক কমলাকান্ত। হ্যাঁ, ঐতিহাসিক শাক্তকবি, গায়ক, সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। আর সেই মূর্তির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

কমলাকান্তর জন্ম বর্ধমানের চাঁপা গ্রামে। আনুমানিক ১৭৬৯ কিংবা ১৭৭২ সালে। ছোটোবেলাতেই হারিয়েছিলেন বাবাকে। আর সেই শূন্যস্থানে জায়গা করে নিয়েছিল আধ্যাত্মিকতা। কিশোর বয়সেই বিশালক্ষ্মী মন্দিরের পঞ্চমুণ্ডীর আসনে সিদ্ধিলাভ করেন কমলাকান্ত। বয়স যত বেড়েছে তাঁর কালীসাধনার কথা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। 

বর্ধমানের মহারাজ তৈজশচন্দ্রের (ওরফে মহারাজ তেজচাঁদ) কানেও পৌঁছেছিল সেই কথা। তিনিই কমলাকান্তকে আমন্ত্রণ জানান দরবারে। তাঁর আধ্যাত্মিকতা এবং শক্তিসাধনায় মুগ্ধ হয়ে নিয়েছিলেন দীক্ষাও। বর্ধমান রাজবাড়ির কাছেই বোরহাট অঞ্চলে তিনি কমলাকান্তকে তৈরি করে দেন একটি মন্দির। আর সাধনার জন্য হাত খানেকের এক পাথরের কালীমূর্তি। তবে সাধারণ পরিচিত কালীমূর্তির থেকে একটু অন্য এই বিগ্রহ। দেবীর পায়ের তলায় ছিল না শিবমূর্তি। কথিত আছে, কমলাকান্ত শায়িত অবস্থায় নিজের বুকের ওপর এই মূর্তি রেখেই আরাধনা করতেন দেবীর।

তৈজশচন্দ্রের পুত্র প্রতাপচন্দ্রও পরবর্তীকালে দীক্ষা নিয়েছিলেন কমলাকান্তের থেকে। ছিলেন তাঁর প্রিয় শিস্যদের মধ্যে অন্যতম। কমলাকান্তের সৃষ্টি সংগ্রহ এবং সংকলনের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন তিনি। ১৮২১ সালে বোরহাটে মারা যান সাধক কমলাকান্ত। তবে থেকে যায় মন্দিরটি। চলত নিয়মমাফিক পূজা-অর্চনাও। তার বছর ষাটেক পরে ঘটে সেই ডাকাতির ঘটনা।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

 

বজবজে দেবী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর দয়াল ঠাকুর মন্দিরের পুজোর জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন ফুল্লরাপীঠের পুরোহিত রামজী সাধুকে। তান্ত্রিক জীবনের আগে এই দুই সাধকই কাজ করতেন ব্রিটিশ বাহিনীতে। পরিচয় সেই সময় থেকেই। অযোধ্যা নিবাসী বলভদ্র পাণ্ডে অর্থাৎ রামজী সাধু বেশ কিছু বছর ছিলেন বজবজের শতাব্দীপ্রাচীন এই কালীমন্দিরে। বিগ্রহের আকারের কারণেই ‘খুকী মাঈ’ বলে দেবীকে ডাকতেন রামজী সাধু। তা থেকেই ছোট্ট মফস্বলে ‘খুকী মা’ হিসাবে বিখ্যাত হন ঐতিহাসিক দেবীমূর্তি। 

তবে এই পুরো গল্প অজানা হলেও রামজী সাধুকে অনেকেই চেনেন। একটু অন্যভাবে। লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসে ‘গোঁসাইবাবা’ চরিত্রটির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিই হলেন আসলে রামজী সাধু। আর ‘ধাত্রীদেবতা’ যে মূলত তারাশঙ্করেরই আত্মজীবনী, তার উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরই চিঠিতে। মৃত্যুর আগের দিন অবধিও তাঁর সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এমনকি তিনিই তৈরি করে দেন করেন রামজী সাধুর সমাধি। সে এক অন্য ইতিহাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও বেশ কয়েকবার এসেছেন বজবজের কালীবাড়িতে।

বর্ধমানে কমলাকান্তের সেই মন্দিরে নবপ্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ

 

যাই হোক, গোলপাতার সেই ছাউনি থেকে বজবজ কালীবাড়ির মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রামজী সাধুর আমলেই। গঙ্গার লাগোয়া অঞ্চলে প্রায়ই বানের জলে প্লাবিত হত কুটির। বজবজেরই বাসিন্দা, একটি যাত্রা দলের মূল কর্মকর্তা অধর দাস ছিলেন রামজী সাধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। সমস্যার সমাধান করতে তিনিই তৈরি করে দেন আট ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট পাকা মন্দির। তবে ধীরে ধীরে পরিধি বেড়েছে তার। কালীমন্দিরের পাশাপাশিই কালীবাড়ির প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে একাধিক দেব-দেবীর মন্দির।

আর বর্ধমানের কমলাকান্তের সেই মন্দির? মূর্তি চুরি যাওয়ার পর থেকে সেখানে পুজো হত দেবীর মাটির মূর্তিই। কালীপুজোর সময় চলত তিনদিনব্যাপী উৎসব। তবে ২০১৫ সালে সেই মন্দিরের পুনর্গঠন হয়েছে। প্রতিষ্ঠা হয়েছে ছ’ফুটের পাথরের কালীমূর্তি। পৃষ্ঠপোষক বর্ধমান রাজপরিবারই।


সাধক কমলাকান্তের বাড়ির স্মৃতিফলক, বর্ধমান 

 

বোরহাট আর বজবজ— শতাব্দী পেরিয়ে এসে এই দুই শহরের মধ্যে এখনও ইতিহাস আর অতীতের সাক্ষ বয়ে নিয়ে চলেছে দুটি মন্দির। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার শাক্ত সাহিত্য আর মাতৃশক্তি আরাধনার প্রাচীন গল্পেরা।

এখানেই ইতি টানা যেত এই গল্পের। তবে প্রসঙ্গ সূত্রে আরও একটি কথা উল্লেখ করে রাখা যাক। ১৮৯৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। শিকাগো ধর্মসম্মেলন থেকে দেশে ফেরেন স্বামী বিবেকানন্দ। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর তিনি প্রথম পা রেখেছিলেন বজ বজেরই মাটিতে। বজ বজ কালীবাড়ি কয়েকশো মিটার দূরে অবস্থিত বন্দরেই নোঙর ফেলেছিল তাঁর জাহাজ। উল্লেখ্য, এই বন্ধরেই ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল কয়েকশো গদর বিপ্লবী। ইতিহাসের পাতায় সেই ঘটনা লিখিত আছে কোমাগাতা মারু ঘটনা নামে। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। রাতটুকু এই বন্দরে কাটিয়ে, ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোরেই শিয়ালদহের ট্রেনে চেপে আলমবাজার মঠের দিকে যাত্রা করেন স্বামীজি। বজ বজ বন্দরে রাত্রিযাপনের সময় তাঁর কানেও কি পৌঁছেছিল মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি? তিনি কি জানতেন তাঁর অদূরেই অবস্থান করছেন আরেক কালীসাধক কমলাকান্তের পূজিত ঐতিহাসিক মাতৃমূর্তি? 

তথ্যঋণ-
১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠিগুচ্ছ, বজবজ পাবলিক লাইব্রেরী
২. ঐতিহাসিক গণেশ ঘোষ, বজবজ
৩. ঐতিহাসিক বিমল পণ্ডিত, বজবজ

Powered by Froala Editor

More From Author See More