হাসির মহামারি! শুনলে মনে হবে অবিশ্বাস্য। কিন্তু ব্যাপারটা হাসির ছিল না মোটেই। কয়েকশো কিশোর-কিশোরীর অট্টহাস্য রীতিমতো ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিল টাঙ্গানিকা (Tanganyika) দেশে। অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেকেই। বন্ধ হয় পড়াশোনা। না, কোনো আনন্দ থেকে শুরু হয়নি হাসির কলরোল। বরং বলা যেতে পারে এক ধরনের ‘ব্যাধি’। যার নামই হয়ে গেছিল ‘টাঙ্গানিকা লাফটার এপিডেমিক’ (Tanganyika Laughter Epidemic)। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এর কারণ।
আজকের তানজানিয়া দেশটি তখনও পরিচিত ছিল টাঙ্গানিকা নামে। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি। আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল কাশাশা গ্রামের জীবন। মিশনারি বোর্ডিং স্কুলের ১৫৯ জন পড়ুয়া নিয়ে চলছিল পড়াশোনা। হঠাৎ হাসতে শুরু করে তিন ছাত্রী। প্রথমে মনে হয়, কমবয়সী ছাত্রীরা হয়তো অকারণেই হাসছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সংক্রামক ব্যাধির মতো তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা স্কুলে। আরো ৯৫ জন ছাত্রছাত্রী যোগ দেয় হাসির ‘ব্যাধি’-তে। প্রত্যেকেরই বয়স ১২ থেকে ১৮-র মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই হকচকিয়ে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। একে অপরকে দেখে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তারা। শান্ত করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। ‘হাসি’ বললে বোধহয় ভুল হবে, কারণ চোখে-মুখে হাসির ঝলক থাকলেও আচার-আচরণ কোনোভাবেই ‘স্বাভাবিক’ নয়। স্কুলবাড়ি জুড়ে গমগম করতে থাকে হাসির শব্দ। অথচ, পূর্ণবয়স্ক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তো বিন্দুমাত্র হাসি পাচ্ছে না।
বিষয়টা কিন্তু এখানে থামল না। টানা ৪৮ দিন ধরে চলল হাসির দমক। প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত ১৮ মার্চ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয় স্কুলটি। আশা করা গেছিল, কয়েক মাসের ছুটিতে হয়তো মিলবে সমাধান। কিন্তু ২১ মে স্কুল খুলতেই দেখা দিল একই উপসর্গ। বাকি ৫৭ জন পড়ুয়াও আক্রান্ত হয় হাসির ‘ব্যাধি’-তে। ফের বন্ধ হয়ে যায় স্কুলটি।
ততদিনে এই ‘রোগ’ ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের গ্রামেও। এই স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রীর বাড়ি ছিল নশাম্বা গ্রামে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে সেই গ্রামেও তৈরি হয় একই পরিস্থিতি। ২১৭ জন বালক-বালিকার হাসি চলল প্রায় ৩৪ দিন। জুন মাসের মধ্যে রামাশ্যেনে স্কুলের ৪৮ জন-সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে আক্রান্ত হয় আরো অনেকে। প্রত্যেকেরই বয়স ওই বারো থেকে কুড়ির মধ্যে। প্রায় ১৮ মাস ধরে চলে হাসির আতঙ্ক। ১০০০ জনের মধ্যে দেখা যায় উপসর্গ। বন্ধ করে দিতে হয় ১৪টি স্কুল।
আরও পড়ুন
হাসি ‘বিক্রি’ করেই শিশুদের মন সারান দিল্লির অধ্যাপিকা
তবে শুধু হাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না ব্যাপারটি। একটানা হাসতে হাসতে যেন আক্ষরিক অর্থেই চোখ ফেটে জল আসে অনেকের। জোর করে হাসি থামাতে গিয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তার সঙ্গে তীব্র শ্বাসকষ্ট, অকারণে চিৎকার করতে থাকা কিংবা সারা শরীরে র্যাশ বেরোনোর সমস্যাও দেখা দেয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে পাওয়া যায়নি কোনো মৃত্যুসংবাদ।
আরও পড়ুন
মোনালিসার হাসি কীভাবে এঁকেছিলেন ভিঞ্চি? পাঁচ শতক পরে সমাধান রহস্যের
কিন্তু কেন হল এরকম? সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, মনের আনন্দ হাসির উৎস। এক্ষেত্রে অবশ্য ঘটেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক চাপ থেকেই শুরু হয় এই ‘মাস হিস্টেরিয়া’। যার উত্তর খুঁজতে হলে একবার পাতা উল্টোতে হবে টাঙ্গানিকার ইতিহাসের। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির বিভিন্ন অংশ কখনও জার্মানি, কখনও ইংল্যান্ডের অধীনে ছিল দীর্ঘদিন। স্বাধীনতা পায় ১৯৬১ সালে। এই ঘটনার এক-দেড় মাস আগে। নতুন দেশ, নতুন স্বপ্নের শুরু। তার কারিগর এই কিশোর-কিশোরীরা। অথচ দেশে প্রবল আর্থিক সংকট, আদৌ ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে কিনা জানে না তারা। স্বাধীন দেশের পরিবর্তমান সংস্কৃতির সঙ্গে চলছে প্রতিযোগিতা। একটা অনিশ্চিয়তা, ভয় কাজ করছে প্রতি মুহূর্তে। আবার রয়েছে স্বাধীনতার আনন্দ। ছোটো ছোটো মাথাগুলো কি পারে এত মানসিক চাপ সামলাতে? সেই সব কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হাসির মধ্যে দিয়ে।
টাঙ্গানিকার হাসির মহামারির পরপরই উগান্ডার বিভিন্ন অংশে শুরু হয় দৌঁড়োনোর ‘অসুখ’। আশ্চর্যের বিষয়, এক্ষেত্রেও জড়িয়ে আছে সে দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি। সমগ্র দেশজুড়ে তৈরি হওয়া অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা পরিণত হয়েছে কখনও দৌঁড়োনো, কখনও-বা হাসির গণব্যাধিতে। হাসির আড়ালেও যে কত বেদনা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা কিন্তু টাঙ্গানিকা হাসতে হাসতে দেখিয়ে দিয়েছিল।
Powered by Froala Editor