আমেরিকার বিখ্যাত ‘হলিউড ওয়াক অফ ফেম’-এর পাশ দিয়ে হাঁটলে দেখা যাবে, ফুটপাতের ওপর অসংখ্য তারা বসানো। এক একটি তারা এক একজন কিংবদন্তি অভিনেতা, অভিনেত্রী, চরিত্রকে সম্মান জানাচ্ছে। সেই সারণি দিয়ে হাঁটলে এক জায়গায় এসে চোখ থমকে যাবে। যদি আপনি ভারতীয় হন, তাহলে হয়ত শিহরণও খেলে যাবে শরীরে। ওয়াক অফ ফেমেরই একটি তারায় লেখা আছে ‘সাবু’! ভালো করে বললে, সাবু দাস্তগীর। নির্ঘাত ভারতীয় নাম! আর তাঁর নামই জায়গা পেয়েছে হলিউডের সেরা অভিনেতাদের জায়গায়। কী তাঁর পরিচয়? কে এই ‘সাবু’?
ভারতের ‘হলিউডি’ যোগাযোগ বললেই ভেসে আসবে ইরফান খান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়াদের নাম। কিন্তু সেসব তো সাম্প্রতিক সংযোজন। আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে ১৩ বছর বয়সী এক ভারতীয় কিশোর প্রথমবার হলিউডের সিনেমায় পা রেখেছিল। তিনি অভিনেতা ছিলেন না, তাঁর পরিবারের কেউ আগে এই পেশায় আসেনওনি। কিন্তু ভাগ্যের চাকা সেই কিশোরকে নিয়ে গেল সাগরপাড়ে। জন্ম নিলেন সাবু দাস্তগীর বা শুধুই ‘সাবু’। হলিউডের আঙিনায় প্রথম ভারতীয় প্রতিনিধি…
তখন ব্রিটিশ শাসন পুরোপুরি বজায় রয়েছে ভারতে। তার ভেতরেই করদ রাজ্য হিসেবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে মহীশূর (অধুনা মাইসোর)। সেখানকার রাজার অধীনেই কাজ করতেন এক মাহুত। হাতিদের নিয়েই চলত জীবন। ছোটো থেকে সেই পরিবেশেই বেড়ে উঠছিলেন শেখ দাস্তগীর এবং তাঁর ভাই সেলার সাবু। হঠাৎই পরিবারে ছন্দপতন। অকালেই মারা গেলেন বাবা। পরিবারের আর্থিক অবস্থা থমকে গেল। বাধ্য হয়েই রাজার অধীনে কাজ করতে নেমে গেলেন দুই ভাই। বাকি জীবনটা হয়তো এভাবেই কেটে যাবে তাঁদের। এর থেকে বেশি কিই বা ভাবতে পারতেন!
কিন্তু জীবনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে নিয়ে যায় আমাদের, বোঝাই যায় না। ততদিনে রুডইয়ার্ড কিপলিং লিখে ফেলেছেন ‘জাঙ্গল বুক’। মোগলির অ্যাডভেঞ্চারে একটু একটু করে মেতে উঠছে গোটা পৃথিবী। ভারতের বুকে বেড়ে ওঠা কিপলিং এখানেই থামেননি অবশ্য। লিখে ফেলেছিলেন এই স্বাদেরই আরও একটি গল্প, ‘টুমাই অফ দ্য এলিফ্যান্ট’। এক ছোট্ট মাহুতের জীবন নিয়ে একটি গল্প। সেটাই নজর কাড়ে পরিচালক রবার্ট ফ্লাহার্টি’র। ঠিক করলেন এই গল্প নিয়েই ছবি করবেন। নামও ঠিক হয়ে গেল- ‘এলিফ্যান্ট বয়’। সবই তো হল; কিন্তু এই ‘বয়’টি কে হবেন? শুটিংয়ের জন্য ফ্লাহার্টি’র পুরো টিম চলে এসেছিল মাইসোরে। তখনই পরিচালক প্রথমবার দেখেন সাবু’কে। ১৩ বছরের এক কিশোর কি অবলীলায় ওই বিশাল প্রাণীটির সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে! কি স্বতঃস্ফূর্ত সেই আবেদন! এমন একটি ছেলেকেই তো তাঁর দরকার ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাবু’কে সিনেমার দলে নিয়ে নিলেন তিনি। ছোট্ট মাহুতের চরিত্রে সেটাই ছিল প্রথমবার সিনেমায় নামা। দাদার সঙ্গে তিনিও পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। মাইসোর তখন অতীত। ভাগ্য ক্রমশ মোড় ঘোরাচ্ছে। ‘সেলার সাবু’ নামটিও অতীত তখন। বদলে নতুন নাম তৈরি হল তাঁর— ‘সাবু দাস্তগীর’ ওরফে সাবু…
১৯৩৭ সালে ‘এলিফ্যান্ট বয়’ মুক্তি পাওয়ার পর সাবু’র সঙ্গে পরিচিত হল গোটা বিশ্ব। পর্দায় তাঁর সাবলীল অভিনয় নজর কাড়ল অনেকের। রাতারাতি লাইমলাইটের আলোয় চলে এলেন তিনি। ঠিক পরের বছরেই অভিনয় করলেন আরও একটি সিনেমায়, নাম ‘দ্য ড্রাম’। মাহুতের চরিত্র থেকে একলাফে চলে এলেন রাজপুত্র আজিমের চরিত্রে। এখানেও নজর কাড়লেন সাবু। একটু একটু করে রাস্তাটা পরিষ্কার হচ্ছিল। বিদেশই হয়ে গেল তাঁর ঘরবাড়ি। ১৯৪০ সালে আরও একটা বড়ো ঘটনা ঘটে গেল জীবনে। এবার অভিনয় করলেন বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য থিফ অফ বাগদাদ’-এ। সেই সময় দাঁড়িয়ে এত বড়ো বাজেটের সিনেমা খুব কমই হয়েছিল। ছবির স্পেশ্যাল এফেক্টে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল অনেকের। তার পুরস্কারও এসেছিল। সাবু দাস্তগীর অভিনীত তৃতীয় ছবিটিই অস্কারের মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছিল। তিন তিনটে বিভাগে পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিল সেবার। আর সাবু? তিনি তখন স্বপ্নের মধ্যগগনে…
ভারত তখন অনেক দূরে। আমেরিকার বুকেই নিজের জীবন অতিবাহিত করবেন, এমনটাই ভাবছিলেন সাবু। এখানে তাঁর একটা পরিচিতি হয়েছে, একটা জীবন তৈরি হয়েছে; ভারতে গেলে তো আবার শূন্য থেকে শুরু! ১৯৪৪ সালে পাকাপাকিভাবে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন অভিনেতা সাবু দাস্তগীর। এরপরই বাঁক নিলেন সম্পূর্ণ অন্যদিকে। তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ থামেনি। জাপানের বুকে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটেনি। সাবু ঠিক করলেন, অনেক তো অভিনয় হল। এবার যদি যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন! মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণের পর আমেরিকার বায়ুসেনাতে যুক্ত হন সাবু দাস্তগীর। ৩৭০ বোম্বার্ডমেন্ট স্কোয়াড্রনের হয়ে আকাশপথে যুদ্ধবিমান নিয়ে পাড়ি দিলেন তিনি। পরবর্তীকালে এজন্য ফ্লাইং ক্রসও পান।
আরও পড়ুন
পরাধীনতার হতাশা মণ্ডপজুড়ে, সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে সেই প্রথম থিমপুজো কলকাতায়
তবে এসবের জন্য বন্ধ হয়নি অভিনয় জীবন। ‘কোবরা ওম্যান’, ‘ব্ল্যাক নার্সিসাস’, ‘সং অফ ইন্ডিয়া’… ছবির সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এই সূত্রেই আলাপ হয় অভিনেত্রী মেরিলিন কুপারের সঙ্গে। ততদিনে পুরোদস্তুর আমেরিকার নাগরিক তিনি। তাঁর নিজের নামেও সিনেমা হয়েছে হলিউডে। তারপরও ভারতের জন্য কি একটুও চিন্তা হয়নি তাঁর? ১৯৫৭ সালে হয়ত ছবিটা বদলে যেতে পারত। মেহবুব খান তাঁর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে বিরজু’র চরিত্রের জন্য সাবু দাস্তগীরের কথাই ভেবেছিলেন প্রথমে। এই সিনেমার হাত ধরে বলিউডেও অভিষেক হতে পারত তাঁর। কিন্তু, হয়নি সেসব। পরে সেই চরিত্রটির জন্য মনোনীত হন অভিনেতা সুনীল দত্ত। বলিউডের মাটি ছোঁয়া আর হয়নি সাবু’র…
কখনও অভিনয়, যোদ্ধা, আবার কখনও হ্যারিংগে সার্কাসের কুশলী— ৩৯ বছরের স্বল্প জীবনে নানা ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। শরীরও যথেষ্ট সবল ছিল। ১৯৬০ সালে যখন হলিউড ওয়াক অফ ফেমে জায়গা পান, তখন মনে হয়েছিল এবার আরও বেশি করে কাজের সঙ্গে জুড়ে যাবেন সাবু। সেসবে ছেদ পড়ল ১৯৬৩ সালে। আর এক মাস পরেই জন্মদিন। হঠাৎই বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন হলিউডের প্রথম সুপারস্টার ভারতীয়। আর বাঁচানো যায়নি…
তথ্যসূত্র –
১) ‘Sabu Dastagir, the actor who crossed over to Hollywood on the back of an Elephant’, Anu Kumar, Scroll
২) ‘Sabu Dastagir- The first Indian actor in a Hollywood movie’, Medium
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকেই দেশের প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ, ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বাঙালি ডাক্তার
Powered by Froala Editor