কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণ উপকূলবর্তী অঞ্চলটি শুধু ইউক্রেন নয়, গোটা ইউরোপের অন্যতম বায়োস্ফিয়ার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর শীতকালে ব্ল্যাক সি সংরক্ষিত অরণ্যে ভিড় জমায় প্রায় দেড় লক্ষাধিক পরিযায়ী পাখি। যার মধ্যে রয়েছে হোয়াইট-টেল ঈগল, মার্গানসার, ব্ল্যাক-ফেদারার্ড স্টিল্টের মতো বিরল প্রজাতিও। তাছাড়াও এই রিজার্ভ (Black Sea Bio Reserve) ব্ল্যাক সি বটলনোজ ডলফিন, মোলাস্ক, মোল র্যাটের মতো বিপন্নপ্রায় প্রাণীদেরও বাসস্থান। তাছাড়া অসংখ্য উদ্ভিদ প্রজাতি তো রয়েছেই।
ইউক্রেনের এই উল্লেখযোগ্য বায়োস্ফিয়ারই এখন রণক্ষেত্র (War Field)। আর তা নিয়েই চিন্তিত ইউক্রেনের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রক, পরিবেশকর্মী এবং আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থারা। ইউক্রেন-রুশ সংঘাতের জেরে ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশের ক্ষতি হয়ে চলেছে বলেই অভিমত তাঁদের। যদিও এই অঞ্চলে বন্যপ্রাণীদের হতাহতের কোনো খবরই প্রকাশ্যে আসেনি এখনও পর্যন্ত। অবশ্য তার একটি কারণ, গোটা বায়োরিজার্ভ রুশ বাহিনীর দখলে থাকায় সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির কোনো খবরাখবরই জানতে পারছেন না পরিবেশকর্মীরা। তবে ইউক্রেনের পরিবেশ মন্ত্রকের এই অভিযোগ কীসের ভিত্তিতে?
ব্ল্যাক সি বায়োরিজার্ভ নিয়ে গবেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল গত মাসেই। মার্চের শেষের দিকে একটি ইউরোপীয় স্যাটেলাইটের ছবিতে ধরা পড়েছিল, সামরিক কর্মকাণ্ড এবং সংঘাতের জেরে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে ব্ল্যাক সি বায়োস্ফিয়ারের একটি বড়ো অংশ। তাতে বন্যপ্রাণীরা প্রাণ হারিয়েছে কিনা বলা না গেলেও, নিশ্চিতভাবেই পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখান থেকেই ক্রমশ ঘনাচ্ছে আশঙ্কা।
তবে এখানেই শেষ নয়। ইউক্রেনের এই রিজার্ভ বায়োস্ফিয়ারে কার্যত মানুষের পদচিহ্ন পড়ে না বললেই চলে। বাফার জোনের সামান্য অঞ্চল ছাড়া পুরো বায়োস্ফিয়ারে নিষিদ্ধ পর্যটনও। বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষার কথা ভেবেই এই বন্দোবস্ত। বর্তমানে সেখানে সৈন্যদের উপস্থিতি, অস্ত্রের ব্যবহার এবং ভারি যুদ্ধযানের চলাচল এককথায় অতিষ্ঠ করে তুলছে বন্যপ্রাণীদের। আশি-নব্বইয়ের দশকে ইউক্রেন থেকে অবলুপ্ত হতে বসা ধূসর নেকড়ে, রেড ফক্স, র্যাকুন, প্রজেওলাস্কি ঘোড়ার মতো প্রজাতিদের জনসংখ্যা ফিরিয়ে এনেছিল ব্ল্যাক সি বায়োস্ফিয়ার। মানুষ তথা সেনা কার্যকলাপে তারাও ক্রমশ এই অরণ্য ছাড়তে পারে ভীত হয়ে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ, গ্রেপ্তার রুশ বৃদ্ধা
এখানেই শেষ নয়। গোটা বায়োরিজার্ভ জুড়েই রুশ সেনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে অজস্র ল্যান্ডমাইন এবং বুবিট্র্যাপ। প্রতিপক্ষের সৈন্যরা যাতে অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বদলে এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে বন্যপ্রাণীরা। সেইসঙ্গে ইউক্রেনের একাধিক পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং অধিগ্রহণ ক্রমশ ঘনিয়ে তুলছে নিউক্লিয় বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকেও। ফলে ইউক্রেন তথা ইউরোপের পরিবেশ মোটেই নিরাপদ নেই আর।
আরও পড়ুন
ইউক্রেনে ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ রাশিয়ার, কেন নিষিদ্ধ এই বোমা?
সম্প্রতি আরও একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাও যেন সমর্থন করছে এই সম্ভাবনাকেই। ১৯৫০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশ্লেষণ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। তাতে স্পষ্টতই উঠে এসেছে যেকোনো যুদ্ধের পরই বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে আকস্মিকভাবেই। এবং সেই হার চোরাশিকার কিংবা অরণ্য নিধনের থেকেও কয়েকগুণ দ্রুত। এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে পরিবেশের সময় লাগতে পারে প্রায় কয়েক দশক পর্যন্ত। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও কি ঘটতে চলেছে এই ঘটনাই? জানা নেই উত্তর…
আরও পড়ুন
মৃত্যু বনাম ভাগ্যের দ্বৈরথ, কীভাবে জন্ম হয়েছিল রাশিয়ান রুলেটের?
Powered by Froala Editor