কথায় বলে, আর কেউ আপন করুক ছাই না করুক, কলকাতা ঠিক কাছে টেনে নেয় সবাইকে। যুগে যুগে ‘সিটি অফ জয়’-এর আকর্ষণও সেই জায়গায়। কত লোকে এসেছে, গেছে; যাওয়ার আগে শহরের বুকে নিজের মতো ছাপ রেখে গেছে। জমিদার, নবাবরা তো বটেই; ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ ও সর্বোপরি ইংরেজরা ছুঁয়ে গেছে তিলোত্তমা। ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতা বারবার আক্রমণের মুখেও পড়েছে। অধিকারের এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল রাশিয়াও।
উনবিংশ শতক। পলাশির ‘নবাবি’ ইতিহাস পেরিয়ে, বাংলা ও ভারত দখল করে বসে আছে পরাক্রমশালী ব্রিটিশরা। কলকাতা সেই সোনার সাম্রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু সেই সময়ই দেখা দিল আতঙ্ক। ব্রিটিশদের সাধের শহর দখল করে নিতে পারে রুশ বাহিনী! এই ভাবনা সেই সময় রীতিমতো ফোবিয়ায় পরিণত হয়। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত জারি ছিল এমন অবস্থা। এর প্রমাণ ১৮৩৫ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নথি।
অবশ্য এর কারণও ছিল। সেই সময়ের পত্র-পত্রিকা ও বেশ কিছু বইতেও এই রুশভীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। সব জায়গাতে এটাই স্পষ্ট, তখন ইংরেজদের একটাই ভয় ছিল রাশিয়া। হাতের কাছে এমন সোনার শহর, সোনার দেশ পেয়েছিল ব্রিটিশরা; সেটাকে কি করে এত সহজে হাতছাড়া করবে! কাজেই যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হল ১৮৩০-এর গোড়া থেকেই। ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ— সবাইকেই পরাস্ত করা হয়ে গেছে প্রায়। এখন যদি রাশিয়াও থাবা মারে! এটাই ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির মূল চিন্তা। একবার বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক খবর পেলেন, বিশাল সংখ্যক রুশ বাহিনী ভারতের দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁরা ভারত দখল করবে। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠালেন ইংল্যান্ডে; সুরক্ষা খাতে খরচ বাবদ এক কোটি পাউন্ড চাইলেন তিনি! এই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল ভয়…
সিপাহী বিদ্রোহের পর এই ঘটনা আরও বেড়ে গেল। সবার নজর তখন একটাই দিকে। উত্তর-পশ্চিম থেকে কি কোনো বিদেশি সৈন্যবাহিনী এগিয়ে আসছে? এই সন্দেহে লেখা হতে থাকল একের পর এক বই, রিপোর্ট। ১৮৯০ সালে ইভান বাতিউস্কার একটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদও ছড়িয়ে পড়তে লাগল সব জায়গায়। কীভাবে কলকাতায় রাশিয়ান ফৌজের হাতে পরাজিত হল ব্রিটিশ রাজশক্তি, সেটারই কাল্পনিক কাহিনি ছিল এই বইতে। যেন সবার মনে সেটাই সত্যি হয়ে উঠে আসতে লাগল।
এমনটা কিছু যে হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। তবে শুধু রুশরাই এখানে আক্রমণ করবে, তা-ই নয়। উল্টো ইচ্ছেটা ছিল ভারতের ইংরেজদেরও। সেটা হয়নি অবশ্য। কিন্তু রুশ-ভীতি যে ব্যাপকভাবে সেই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতায়, সেটাই বলছে ইতিহাস। সত্যিই যদি রাশিয়া থেকে আক্রমণ ধেয়ে আসত, তখন কী হত? কল্পনার আশ্রয় নিই আমরা…
ঋণ – শ্রীপান্থের কলকাতা/ শ্রীপান্থ
Powered by Froala Editor