স্মার্টফোন স্বাধীনচেতা করছে গ্রামীণ মহিলাদের, স্বপ্ন দেখাচ্ছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের

প্রায় কুড়ি কোটি মহিলা নিরক্ষর এই দেশে। মহিলাদের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলো না আসলেও, অন্য ভাবে একচিলতে রোদ্দুর ঠিকই এসে পড়েছে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকা অন্ধকার উঠোনে। এবং গত কয়েক বছরে হয় এই পরিবর্তনের পিছনে প্রযুক্তির অবদান অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। সস্তা স্মার্টফোন, মোবাইল ডেটা এবং বেশ কিছু অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনগুলির মাধ্যমে মহিলারা বর্তমানে সহজেই একে অন্যের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। সক্ষম হয়েছেন গোষ্ঠী তৈরি করতে এবং বাজারে অর্থাৎ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এটা? কখনোই পড়াশোনা না করা মহিলারা কীভাবে ব্যবহার করছেন মোবাইল বা ইন্টারনেট?

এখানে ‘গেম চেঞ্জার’ সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া মোবাইল প্রযুক্তি। হাতে না লিখতে পারলেও ভয়েস কম্যান্ড দিয়েই মোবাইলে বিভিন্ন তথ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব এখনকার সময়ে। সেই সুবিধাই কাজে লাগিয়েছেন প্রান্তিক বা গ্রামীণ মহিলারা, যা অবশ্যই তাক লাগানো।

যদিও এর আগে, ২০১৮ সালেই লেখক রবি আগরওয়াল তাঁর বই 'ইন্ডিয়া কানেক্টেড'-এ দেখিয়েছিলেন কীভাবে স্মার্টফোন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে রূপান্তরিত করেছে। বস্তুত, শুধুমাত্র মহিলারাই নন, অনেক দেশবাসীই জানিয়েছিলেন, স্মার্টফোনই হল তাদের প্রথম টিভি স্ক্রিন, ব্যক্তিগত মিউজিক প্লেয়ার, কম্পিউটার এবং ক্যামেরা। আগরওয়াল এটিকে তুলনা করেছিলেন প্রথমবার 'স্বায়ত্তশাসন, গোপনীয়তা এবং গতিশীলতা' অর্জন করার সঙ্গে।

২০১৫ সালে, ভারতের গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মাত্র ১০ শতাংশ ছিলেন মহিলা। ইন্টারনেট এবং টেলিকম সংস্থাগুলির একটি ট্রেড গ্রুপ আইএএমএআই-এর মতে স্মার্টফোন এবং ডেটা প্ল্যানগুলি আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠায়, এই সংখ্যাটি বর্তমানে পৌঁছেছে প্রায় ৩০ শতাংশে।

আরও পড়ুন
রাঢ় বাংলার অঘ্রাণ ও গ্রামে-গ্রামে বৈষ্ণবীয় ভোরাই 'টহল'

গত কয়েক বছর ধরেই গুগল, ইনটেল এবং ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলি কাজ করে চলেছে স্থানীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে, যাতে মহিলাদের পক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহার সহজতর হয়। গ্রামীণ মহিলাদেরকে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ দিতে গুগল এবং টাটা ট্রাস্ট নিয়ে এসেছে 'ইন্টারনেট সাথী'র মতো উদ্যোগ। এখানে মহিলাদরকে শুধু স্মার্টফোন ব্যবহার করতেই শেখানো হয় না, প্রয়োজনে ফোন এবং পাওয়ার ব্যাঙ্কও সরবরাহ করা হয়। গত বছরের মধ্যে লাখ খানেকেরও বেশি মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এর মাধ্যমে। 

এই প্রসঙ্গে টাটা ট্রাস্টের অন্যতম প্রধান মুখ রমন কল্যাণকৃষ্ণন বলেছিলেন, চার দিনের প্রশিক্ষণে মূলত জোর দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় ভাষায় ভয়েস কম্যান্ড ব্যবহারের উপর। তারপরে মহিলারাই ঠিক করতেন যে তাঁরা কী শিখতে চায়। তাঁর কথায়, "আমরা আসলে জানিই না আমাদের দেশের, আমাদের ঘরের মেয়েরা কী চায়!"

আরও পড়ুন
ঠিক যেন ‘স্বদেশ’ সিনেমা; খেলনার মাধ্যমেই গ্রামে-গ্রামে বিজ্ঞানের পাঠ দিচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার

অসুস্থ ২০২০ সালের লকডাউন চলাকালীন, এই স্মার্টফোন যে অনেক ভাবে মহিলাদেরকে সাহায্য করেছে, সে কথা স্বীকার করেছেন বহু মহিলাই। সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে গেছে হস্তশিল্প ওয়ার্কশপ বা গ্রাম পঞ্চায়েত মিটিংয়ে কী দাবীদাওয়া নিয়ে সরব হতে হবে, সেই পরিকল্পনার বিষয়ও। উৎসবের মরসুমে কিছুটা হলেও হাল ফিরেছে অর্থনৈতিক ভাবে।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিয়ে। সম্পূর্ণ অস্বীকার করাও যায় না বিষয়টা। এখনও বাস্তবিক ভাবেই ভিডিও বাফার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় কাউকে, ফোন ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে হয় জঙ্গলের, যেখানে পাওয়া যায় নেটওয়ার্ক। তবু প্রযুক্তি আর মোবাইল ইন্টারনেটের উন্নতি যে এক ধাক্কায় অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে পিছনের সারিতে পড়ে থাকা মহিলাদের, সেটা কিছুটা হলেও পরিষ্কার। এখান থেকেই পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার নতুন লড়াই শুরু, এমন প্রত্যাশা তাই করা যেতেই পারে।

আরও পড়ুন
শস্য বুনে-বুনে তৈরি লক্ষ্মীপ্রতিমা, উড়িষ্যার গ্রামবাসীরা আজও ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য

Powered by Froala Editor

More From Author See More