সালটা ১৮৮৪। ভারতের বুকে মেয়েদের তখনও নিজের ইচ্ছা প্রকাশের কোনো উপায় ছিল না। আর অর্থনৈতিকভাবে যে পিছিয়ে থাকে, তার কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না কেউই। ঠিক এই সময়েই বোম্বের আদালতে শুরু হল একটি মামলার শুনানি। বিবাহ-বিছেদের আবেদন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ সাধারণ একটি মেয়ে। ২০ বছরের একটি মেয়ে। ৭ বছর আগে তার সঙ্গে বিবাহ হয় এক যুবকের। ১১ বছরের এক বালিকার বিবাহ তখন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বিবাহের পরেও দিন কাটত পিতৃগৃহেই। এসব অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তাই বলে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন? চমকে উঠেছিল সমস্ত দেশ।
না, তৎকালীন ব্রিটিশ আদালতও একটি মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন স্বীকার করে নেয়নি। আদালত স্পষ্ট নির্দেশ দেয় সংসারে ফিরে যেতে হবে মেয়েটিকে। কিন্তু এই রায়ও মেনে নেয়নি মেয়েটি। আদালত তখন জানায়, রায় না মানলে দিন কাটাতে হবে জেলখানায়। হয় সংসার, নয় জেলখানা। কিন্তু তখনও জেলখানাকেই বেছে নিয়েছিল সেই মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত সেই মামলা গড়িয়েছিল লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস পর্যন্তও। শেষ পর্যন্ত ১৮৯১ সালে এই মামলার সূত্রেই তৈরি হয়েছিল ‘এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট’। আর মেয়েটির বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিয়েছিলেন স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া।
সেদিনের সেই মেয়েটি হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তাদের একজন রুখমাবাই। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবং আনন্দিবাইয়ের কিছু পরেই তিনি ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। আর প্রথম দুজন সেভাবে রোগী দেখার কাজ না করলেও, ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত প্র্যাকটিস অব্যাহত রেখেছিলেন রুখমাবাই। তাই অনেকে বলেন, তিনিই এদেশের প্রথম অনুশীলনকারী মহিলা চিকিৎসক। আর সেইসঙ্গে নারীবাদী আন্দোলনেরও এক কিংবদন্তি তিনি।
১৮৬৪ সালে বোম্বে শহরে জন্ম রুখমাবাইয়ের। তাঁর মাকেও বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়েছিল। ১৪ বছর বয়সে বিবাহ, আর ১৬ বছর বয়সে জন্ম দিয়েছিলেন রুখমাবাইয়ের। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই পিতৃহীন হয়েছিলেন রুখমাবাই। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন দাদাজি ভিকাজি নামে এক মুক্তমনা ব্যক্তি। সেযুগে বিধবা-বিবাহও এক দুঃসাহসিক কাজ বৈকি। তবে সমাজের চাপে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১১ বছর বয়সেই বিবাহ দিয়েছিলেন রুখমাবাইয়ের। দাদাজি অবশ্য ভেবেছিলেন, মেয়ে তো বাড়িতেই থাকবে। পড়াশোনা শেষ করে তারপর শ্বশুরবাড়িতে যাবে। কিন্তু রুখমাবাইয়ের যখন ২০ বছর বয়স, তখনই তাকে নিয়ে যেতে আসেন তাঁর স্বামী। রুখমাবাইয়ের সংসার করতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। আর তাঁর এই ইচ্ছা তাঁর স্বামী মেনে নিতে পারেননি। তাই বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী, স্বামীর মৃত্যুর দিনেও ভোলেননি ‘প্রফেশনালিজম’
১৮৮৪ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত টানা ৭ বছর মামলা চলেছিল। আর এই পুরো সময়টায় মেয়ের পাশে ছিলেন দাদাজি। বিবাহ-বিচ্ছেদের বিনিময়ে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি ছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়ের স্বপ্ন মাঝপথে থেমে যেতে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত সফল হল সেই স্বপ্ন। এর মধ্যেই ১৮৮৯ সালে লন্ডনে চলে যান রুখমাবাই। ভর্তি হলেন স্কুল অফ মেডিক্যাল সায়েন্স ফর ওমায়ন-এ। ১৮৯৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। আর তারপর দুই বিশ্বযুদ্ধ থেকে মহামারী, নানা সময়ে নানা রোগীর চিকিৎসা করে গিয়েছেন তিনি। ১৯৫৫ সালে ৯১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত অসুস্থ রোগীদের সঙ্গেই জীবন কাটিয়েছেন রুখমাবাই।
নিজের জীবন দিয়ে যেমন কিংবদন্তি রচনা করে গিয়েছেন রুখমাবাই, তেমনই রেখে গিয়েছেন তাঁর লড়াইয়ের দলিল। ১৮৮৫ সালে ‘টাইমস’ পত্রিকাকে লেখা চিঠি সেই লড়াইয়ের সাক্ষী দেয়। এখনও সেই চিঠির অনুলিপি পড়তে পারেন যে কেউ। জয়া সাগাদে সম্পাদিত ‘চাইল্ড ম্যারেজ ইন ইন্ডিয়া’ বইতেই সেই চিঠি পাওয়া যায়। আজ এইসব ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। কিন্তু সার্বিক নারী স্বাধীনতা আজও মেলেনি। রুখমাবাইদের সেই লড়াই আজও বয়ে চলেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
আরও পড়ুন
এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয়, গুগল শ্রদ্ধা জানাল বাঙালি সাঁতারুকে
তথ্যসূত্রঃ From a Child Bride to India’s First Practising Woman Doctor: The Untold Story of Rukhmabai, SANCHARI PAL, Better India
Who was Rukhmabai Raut?, Indian Express
ছবিঋণঃ Wikipedia
আরও পড়ুন
কলকাতা পুলিশের প্রথম মহিলা ওসি; দেবশ্রী চ্যাটার্জির অকালমৃত্যু ও একটি ‘বিপ্লবে’র সমাপ্তি
Powered by Froala Editor