ফেরান না প্রায় কাউকেই, গোলাপ দিয়েই ভালোবাসা বুনছেন নাগেরবাজারের ফুলবিক্রেতা

১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসার দিন। বচ্ছরকার এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন অনেকেরই। ভালোবাসাকে কোনো নির্দিষ্ট দিনে বাঁধা যায় না, তা সত্যি। কিন্তু তারপরেও একটি দিনের ওপর আলো ফেলতে চাইলে দোষ কী! অন্তত, এই উপলক্ষে প্রিয়জনের হাতে উপহার তো তুলে দেওয়াই যায়! আর উপহার বলতে আর কিছু থাকুক না থাকুক, একটা লাল গোলাপ তো লাগবেই। তাই এই দিনটাকে ঘিরে ফুলের ব্যবসা বেশ ভালোই জমে ওঠে। তবে প্রতি বছর বাজার বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে মানুষের রুচি। তার প্রভাব কতটা পড়েছে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র ফুলের বাজারে?

এই কথা জানতেই কথা বলছিলাম নাগেরবাজার অঞ্চলের ফুল বিক্রেতা বিশ্বনাথ সাহার সঙ্গে। নয় নয় করে পঁচিশ বছর তিনি কাটিয়ে ফেলেছেন এই ব্যবসায়। প্রতি বছর কত প্রেমিক-প্রেমিকাকে ফুল দিচ্ছেন তিনি। অনেকেই আবার ফুলের তোড়া বানিয়ে দিতে বলেন। তাঁর কাছে নাকি প্রতি বছর অন্তত এমন একজন কিশোর বা কিশোরী আসবেই, খুচরো পয়সা গুনে কুড়ি বা তিরিশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, ‘এতে যা হয় দিন।’ এসব সময়ে অবশ্য ব্যবসার কথা মাথায় রাখেন না তিনি। খানিকটা লোকসান করেও তাদের নতুন প্রেমের উপহার সাজিয়ে দেন।

তবে অন্যসময় ঘোর ব্যবসায়ী বিশ্বনাথবাবু। বললেন, ‘চাহিদা বাড়লে দাম তো বাড়বেই। এই একটা দিনেই তো বিক্রিবাটা খানিকটা ভালো হয়।’ তবে ফুলের বাজার এখন একটু মন্দার দিকে। এমনটাই বক্তব্য বিশ্বনাথবাবুর। বললেন, ‘বাজারে অন্যসব জিনিসের যা দাম, ফুল কিনতে আর টাকা থাকে কোথায়?’ যাঁরা আসেন তাঁরাও একটু দরদাম করে সস্তায় কিনে নিতে চান। ‘কাস্টমার তো দরদাম করবেই।’ তবে অনেকেই এমন আসেন যাঁরা দরদাম করতে চান না। তাঁদের বাজেটও বেশ বেশি থাকে। তবে এমন কাস্টমার অনেক কম। শহরের প্রান্তিক এই অঞ্চলে ফুলের তোড়া বা বাস্কেটের থেকে খুচরো গোলাপের চাহিদাই বেশি। যাঁরা তোড়া বা বাস্কেট কেনেন তাঁরা ডাচ গোলাপ পছন্দ করেন বেশি। তবে খুচরো বিক্রিতে এখনও দেশি গোলাপেরই চাহিদা বেশি।

বাজার মন্দা হলেও এখন গোলাপের বিক্রিবাটা দুদিন হয়। একদিন ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ, রোজ ডে-তে। আর ভ্যালেন্টাইনস ডে তো আছেই। আগে রোজ ডে-তে গোলাপের চাহিদা তেমন ছিল না বলেই জানালেন তিনি। ফলে দুদিন ব্যবসা মোটামুটি পুষিয়ে যায়।

তবে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র উপহার মানে গোলাপের সাথে অবশ্যই টেডি বিয়ার। তাছাড়া নানাধরনের স্টেশনারি আইটেমও থাকে। সেসবের বাজার কিন্তু খুব একটা খারাপ না। তেমনটাই জানালেন কালীচরণ দাস। গত তিরিশ বছর ধরে তিনি তাঁর ছোট্ট দোকানে নানা সিজনে নানা কিছু বিক্রি করেন। দোলের সময় রং, নববর্ষে পঞ্জিকা, কালীপুজোয় বাজিপটকা। শুধু ব্যাঘ্র দিবসে বাঘ বিক্রি করেননি কোনোদিন। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে স্টেশনারি আইটেম নিয়ে অবশ্য তিনি বেশিদিন বসছেন না। ‘বছর পাঁচেক হল এই ব্যবসা বেশ ভালো চলছে।’ তার আগে এইসময় তিনি গ্রিটিংস কার্ড বিক্রি করতেন। তবে এখন আর ছাপা গ্রিটিংস কার্ডের তেমন চাহিদা নেই বলছেন কালীচরণবাবু। ‘খাতা পেনের দোকানে ব্ল্যাঙ্ক গ্রিটিংস কার্ড কিনতে পাওয়া যায়। সবাই এখন নিজের হাতেই বানিয়ে দেয়।’ তবে নতুন এই ব্যবসায় লাভের পরিমাণ খুব একটা খারাপ নয়। শুধু সমস্যা একটাই। ‘সিজন এলেই পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দেয়। সেই দামে কাস্টমাররাও কিনতে পারেন না। আর আমাদেরও ব্যবসা করে পোষায় না।’ তাই আগে থেকেই সব কিনে রাখতে হয়। তবে মল্যবৃদ্ধির প্রভাব তিনিও টের পাচ্ছেন। আগে টেডি বিয়ারের যে পরিমাণ বিক্রি হত, এখন আর সেটা নেই। তার বদলে কোল বালিশের চাহিদা বেড়েছে। ‘সস্তায় হয়ে যায়’, বললেন কালীচরণবাবু।

বাজার বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে চাহিদা। সেই সঙ্গে নতুন নতুন প্রকরণ আসছে। কিন্তু ভ্যালেন্টাইনস ডে-র উষ্ণতা আজও কমেনি। বরং বেড়েছে বললেও ভুল হবে না। একটা কথা তো দুজনের কথাতেই উঠে এল। আগে স্কুল-কলেজের কমবয়সি ছেলেমেয়েরাই ফুল বা টেডি কিনতে আসত। এখন কিন্তু রীতিমতো বৃদ্ধরাও এই দিনের উষ্ণতায় ভাগ বসাতে আসেন। আর এসব নিয়েই সেজে উঠছে একটা দিন। ভালোবাসার দিন। উপহারে-উষ্ণতায় ভরা। তিলোত্তমা কলকাতা তার শরিক হবে না, তা কি হয়!

More From Author See More