বিগত কয়েকদিন ধরেই ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল জল্পনা। মেসির পর এবার ক্লাববদল করতে চলেছেন বর্তমান ফুটবল জগতের আরেক অন্যতম মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। আর জুভেন্তাসে যে রোনাল্ডোর দিন শেষের পথে— কয়েকদিন আগেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কিংবদন্তি ইতালিয়ান ক্লাবটির কোচ ম্যাক্স অ্যালেগ্রি। তবে কোন দলের জার্সি গায়ে তুলবেন তিনি? জল্পনায় উঠে এসেছিল সেই পিএসজি’র নাম। সেইসঙ্গে রোনাল্ডোকে দলে টানতে উঠে পড়ে লেগেছিল ম্যাঞ্চেস্টার সিটিও। শেষ পর্যন্ত সকল জল্পনার অবসান টেনে পুরনো দল ম্যান-ইউতেই প্রত্যাবর্তন করলেন পর্তুগিজ সুপারস্টার।
২০০৩ সাল। স্পোর্টিং লিসবনের মাঠ থেকে প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েছিলেন বছর আঠারোর তরুণ রোনাল্ডো। ফুটবল মাঠে তখন সপ্রতিভ হলেও, অন্যান্যদের থেকে শারীরিক গঠনে বেশ খানিকটা পিছিয়ে ছিলেন অনূর্ধ্ব আঠারোর তরুণটি। ফলত, এমন একজন ‘দুর্বল’ খেলোয়াড়কে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম সারির ক্লাব সই করানো নিয়েই ধেয়ে এসেছিল অজস্র প্রশ্নবাণ। সেদিন বছর আঠারোর সেই তরুণের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্কটিস জিনিয়াস তথা ম্যান-ইউয়ের কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
ফুটবল শুধু ৯০ মিনিটের বল দখলের লড়াই নয়। ফুটবলে জয়-পরাজয়ের বাইরে যে জিনিসটা থেকে যায় তা হল আবেগ, ভালোবাসা সম্পর্ক। প্রায় দু’দশক আগে এমনই এক রূপকথার সম্পর্কের জন্ম দিয়েছিল ওল্ড ট্রাফোর্ড। ম্যাঞ্চেস্টারের লাল শিবিরের মাঠে এক নাটকীয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রোনাল্ডো এবং অ্যালেক্স ফার্গুসনের মধ্যে। পিতৃহারা রোনাল্ডো বাবার আসনেই বসিয়েছিলেন ফার্গুসনকে। আর বাধ্য ছাত্রকে নিজের জ্ঞানভাণ্ডারের সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন স্কটিস জিনিয়াস। ২০০৯ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ড ছাড়ার বেলাতেও সেই বিচ্ছেদের যন্ত্রণার সুর লেগে ছিল গুরু-শিষ্যের গলায়।
পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কিংবা জুভেন্তাসের থেকে রিয়্যাল মাদ্রিদে বহুগুণ বেশি সাফল্য পেয়েছেন সিআর-৭। সাদা জার্সিতে রোনাল্ডোর ট্রফির সংখ্যাও যেমন বেশি, তেমনই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রোনাল্ডোর রেকর্ডের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। কিন্তু রোনাল্ডোর তারকা থেকে মহাতারকা হয়ে ওঠার রূপকথার বীজ যেন রোপণ করা হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টারেই। আর সেই বাগানের একনিষ্ঠ মালি ছিলেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।
আরও পড়ুন
অবশেষে জল্পনার অবসান, পিএসজি-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন লিও মেসি
২০১৫ সালে রিয়্যাল মাদ্রিদে থাকার সময়ই এক প্রেস কনফারেন্সে রোনাল্ডোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করলে কোন দলে খেলবেন তিনি। তখনও পর্তুগিজ তারকাকে পেতে বড়ো অঙ্কের অফার নিয়ে প্রস্তুত ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। প্রশ্নের মধ্যেই উঠে এসেছিল সেই ট্রান্সফার ফি এবং বেতনের হিসেবনিকেশও। তবে উত্তর দিতে এক মুহূর্তও নষ্ট করেননি সিআর-৭। দৃপ্ত কণ্ঠেই জানিয়েছিলেন, “ইংল্যান্ডে ফিরলে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডেই খেলব। সিটিতে নয়। টাকাই ফুটবলের শেষ কথা নয়, প্যাশনটাই আসল। টাকার পিছনে দৌড়াতে হলে ইংল্যান্ড কেন, বরং কাতারে যেতে রাজি আমি।”
আরও পড়ুন
সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনাল্ডো, ছাপিয়ে গেলেন পেলে-কেও
২০২১ সালের ক্লাববদলের ভবিষ্যদ্বাণী কি ৬ বছর আগের দেওয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই করে গিয়েছিলেন সিআর-৭? জানা নেই। তবে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি নতুন চুক্তির জন্য বড়ো অঙ্কের অফার দেওয়ার পরেও যে খুব একটা আগ্রহী নন রোনাল্ডো, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল বেশ ক্ষীণ। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বদলে গেল গোটা প্রেক্ষাপটটাই। আর তাঁর নেপথ্যে সেই স্কটিস জিনিয়াসই। ম্যাঞ্চেস্টারের লাল-নীল শিবিরের জল্পনা ঘনীভূত হতেই গতকাল ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। আর তার মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যেই ক্লাব থেকে যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়, প্রত্যাবর্তন করছেন রোনাল্ডো। এটাই হয়তো ফুটবলের বিস্ময়। আবেগ, রূপকথাও বটে।
আরও পড়ুন
রোনাল্ডোর নামে অ্যাকাডেমির নামকরণ, সিআর৭-কে বিরল সম্মান কৈশোরের ক্লাবের
না, আগামীতে ফুটবলে পিচে গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হিসাবে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে পাবেন না সিআর-৭। বদলে কোচ হিসাবে তাঁকে গাইড করবেন তাঁরই প্রাক্তন সতীর্থ সোল্কজায়ার। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রিয় ছাত্রের খেলা সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে ওল্ড ট্রাফোর্ড আলো করে প্রতিদিনই হাজির হবেন ফার্গুসন। ২০০৮ সালে ফার্গুসন আর রোনাল্ডোর যুগলবন্দিই ম্যান ইউ-কে এনে দিয়েছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি। সেই শেষ। তারপর আর সেইভাবে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ লিগে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি ম্যাঞ্চেস্টারের লাল শিবির। এখন দেখার, রোনাল্ডোর প্রত্যাবর্তনে আবার নতুন করে প্রাণসঞ্চার হয় কিনা সেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে। সেই প্রতীক্ষারই যেন প্রহর গুনছেন প্রাক্তন কারিগর ফার্গুসন…
Powered by Froala Editor