কারাগারের মধ্যে এক জীর্ণ বৃদ্ধ বন্দি, আর গরাদের এপারে তাঁর যুবতী কন্যা দাঁড়িয়ে। মেয়েটির কোলে তার ছোট্ট শিশু। কিন্তু চোখে মুখে এক অদ্ভুত চঞ্চলতা। ছবিটা আরেকটু ভালো করে দেখলে সেই রহস্য বোঝা যাবে। গরাদের ফাঁক দিয়ে মেয়েটি তার অনাবৃত স্তন বাড়িয়ে দিয়েছে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে। আর বৃদ্ধ ক্ষুধার্তের মতো সেই দুধ পান করছে। ফরাসি শিল্পী জুল জোসেফ লাফেব্রের এই ছবিটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। বিখ্যাত এই ছবির নাম 'রোমান চ্যারিটি'। অথবা একই নামে বা বিষয়কে কেন্দ্র করে অন্য অনেক শিল্পীর ছবিই তো দেখেছি। রেনেসাঁসের যুগের বিখ্যাত চিত্রকর জাঁ-ব্যাপটিস্ট গ্রুজের নামই বা ভুলি কী করে? কিন্তু এই ছবির পিছনে যে কিংবদন্তি গল্প লুকিয়ে আছে, তার খবর কতজন রাখি?
রেনেসাঁসের যুগের বেশিরভাগ ছবির মতো এই ছবির পিছনের গল্পটি কিন্তু বাইবেল থেকে নেওয়া হয়নি। যিশুর জন্মের পর তখনও একটা শতাব্দী পেরোয়নি। রোমের নানা অঞ্চলে প্রাচীন পেগান ধর্মের রমরমা চোখে পড়ার মতো। এই গল্প সেই খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের গল্প। গল্প নাকি ইতিহাস, সে প্রশ্ন বিতর্কিত। তবে কারাবন্দি সিমন ও তার কন্যা পেরোর গল্প যে কিংবদন্তি, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। অন্য আরেকটি গল্পে অবশ্য পেরোকে রাজা সিমনের স্ত্রী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে গল্প পৃথক। এই কাহিনিতে সিমন কোনো রাজা নন। সাধারণ একজন মানুষ, কোনো গুরুতর আইন ভাঙার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে দণ্ডিত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিচিত্র রীতি প্রচলিত ছিল তখন। সক্রেটিসকে দেওয়া হয়েছিল হেমলক বিষ। অনেককে শূলে চড়ানো হত, কারোর বুকের উপর হাতির পা রেখে মেরে ফেলা হত। সিমনের মৃত্যুর পথ ছিল অনাহার। তাঁকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়, এবং কারারক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয় কোনরকম খাবার বা জল যেন তাঁকে না দেওয়া হয়।
এভাবেই দেখতে দেখতে দিন কেটে যাচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল, তারপর কয়েক মাস। কিন্তু সিমনের শরীরে মৃত্যুর কোনো লক্ষণ ফুটে উঠছে না। তার শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এতদিন তো বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। এরপর একদিন রহস্য পরিষ্কার হল। সিমনের কন্যা পেরো প্রতিদিন একবার তার বন্দি পিতার সঙ্গে দেখা করতে যেত। এই অনুমতি নেওয়াই ছিল। কিন্তু সেই সুযোগে একটি বেআইনি কাজ করতো সে। নিজের বুকের দুধ ভরে দিত সিমনের ক্ষুধার্ত মুখে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীকে এভাবে খেতে দেওয়া যে 'অপরাধ'। তাই সারাক্ষণ সচকিত দৃষ্টি রাখত চারিদিকে। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে যায়। একজন কারারক্ষী এই দৃশ্য দেখে ফেলে। এবং তৎক্ষণাৎ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে পুরো বিষয়টি জানায়।
এরপরের পরিণতি অবশ্য বিতর্কিত। কেউ বলেন, কন্যার এমন ভালোবাসার কথা শুনে বিচারকের মন কোমল হয়ে উঠেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত সিমনকে মুক্তি দেওয়া হয়। আবার কেউ বলে, আইন ভাঙার অপরাধে পেরোকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে গল্পের পরিণতি যাই হোক না কেন, শিল্পীর মানসপটে যবনিকা পতন ঘটে গিয়েছে অনেক আগেই। বন্দি পিতার শুষ্ক মুখে দুধ ঢেলে দিচ্ছেন কন্যা, এই তো সেই চিরন্তন ভালোবাসার গল্প। এইরকম কাহিনিকে ঘিরে তারপর আরও কত কাহিনি জন্ম নিয়েছে, নিচ্ছে। এমনকি মধ্যযুগে একাধিক শিল্প তৈরি হয়েছে এই কাহিনিকে ঘিরেই।
সিমন এবং পেরোর কাহিনি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছবি আঁকা হয়েছে সপ্তদশ শতকে। তবে কেউই খুব বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন না। 'রোমান চ্যারিটি' নামে প্রথম বিখ্যাত তৈলচিত্রটি আঁকেন জাঁ-ব্যাপটিস্ট গ্রুজ। সেটা অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে। তারপর জোহান যোফ্ফানি, বারবারা ক্র্যাফটের মতো অনেক বিখ্যাত শিল্পীই রঙের আঁচড়ে এই গল্পকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি শিল্পী জুল জোসেফ লাফেব্রের ছবিটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই ছবিটিতেই প্রথম পেরোর কোলে তার সন্তানকে দেখা যায়। তারপরেও অনেক শিল্পী এই একই ছবি এঁকেছেন। ২০১১ সালের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ম্যাক্স সাউকো আবারও একই কাহিনিকে তুলে ধরলেন। এভাবেই তো চিরাচরিত কাহিনির থেকে জন্ম নেয় নতুন সৃষ্টি।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন কাহিনিতেই বোধহয় এমন এক অনুভূতির আবেদন থাকে, সময়ের পরিবর্তনেও যা কোনোদিন পুরনো হয় না। সিমন-পেরোর কাহিনিও তেমনই। অসহায় সন্তানের মুখে বুকের দুধ তুলে দেন মা। এই দৃশ্য তো সচরাচর পরিচিত। কিন্তু সন্তানের জায়গায় যখন সে তার পূর্ববর্তী প্রজন্মকে স্থান দেয়, তখন সেই দৃশ্য এক অদ্ভুত অভিঘাত তৈরি করে। যার মর্মার্থ যুগে যুগে নতুন করে রচনা করেছেন শিল্পীরা। আর সেই সমস্ত শিল্পের পিছনে নীরবে মুখ লুকিয়েছে কিংবদন্তি কাহিনিটি।
Powered by Froala Editor