আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ, জাতিসত্তার উদযাপনে ভেসে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। কমতি নেই অনুষ্ঠানেরও। অথচ এমন এক দিনে কী ভাবছেন সাধারণ মানুষ? ভাষা দিবস নিয়ে কতটা ওয়াকিবহাল তাঁরা? বাংলা ভাষাকেই বা কী চোখে দেখছেন? কলকাতার থেকে সামান্য দূরের এক মফঃস্বল শহরে, বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বললাম আমরা।
প্রথমেই ধরা যাক বিপ্লব সাহার কথা। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেও, নিজের ভাষাকে সবার আগে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন তিনি। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর সামর্থ্য সবার নেই। সেই জন্যই একমাত্র মেয়েকে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বাড়িতে শিক্ষক রেখেছেন ইংরেজির জন্য। তবে বিপ্লববাবুর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মতামত আছে। “কিছু সংখ্যক মানুষ, যাঁদের টাকা পয়সা আছে তাঁরা অনেকেই সন্তানকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ান। ক্লাস ফাইভে আবার বাংলা মাধ্যমে নিয়ে আসেন। এখানেই চলে আসে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতার যত কাছে তুমি যাবে সেখানে বিভিন্ন মানুষের উপস্থিতির জন্য একটা মিশ্র কালচার গড়ে উঠেছে। সেই কারণেই ইংরেজি এবং হিন্দি এই দুটোর প্রচলন একটু বেশি। কিন্তু তুমি একটু মফঃস্বলের দিকে গেলেই দেখতে পারবে যে সেখানে ওই ভাষাগুলোর প্রভাব আসলে অতটাও নেই যতটা আছে শহর কলকাতায়!”
আরও পড়ুন
সাত ভাই আর গাছ-দেবতার গল্প বলে করম পরব
আমরা হাজির হলাম আরেকজনের কাছে। কী ভাবছেন তিনি? বাংলা বই নাকি আজকাল কেউ পড়ে না। এমন অভিযোগ কত জায়গা থেকে শোনা যায়। নানা সময় নানা বিতর্ক আয়োজিত হয় এ নিয়ে। অনেকের মতে, বই না পড়লে এত বিক্রি হচ্ছে কেন! কিন্তু আখেরে যে বই পড়া কমে যাচ্ছে, তেমনটাই মনে করছেন আরেক ব্যবসায়ী রাজীব চক্রবর্তী। তার জায়গায় উঠে আসছে স্মার্টফোন। যে মানুষটি আগে রাতে বই পড়ে ঘুমোতে যেত, সে আজ স্মার্টফোন নিয়ে শোয়। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বাজারের কথাটাও তুললেন রাজীববাবু। “বাংলা বই বিক্রি নিয়ে প্রশ্ন নয়। বই তো বিক্রি হচ্ছেই। কিন্তু ইংরেজির ক্ষেত্রে বাজারটা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।” তারপরেও তিনি আশাবাদী। ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’- এটাই যেন সব কথার শেষ মন্ত্র। বাংলা সাহিত্য, থিয়েটার, চলচ্চিত্র এরপরেও যে ভালো জায়গা নেবে, ভালো কাজ হবে, এ ব্যাপারে তিনি নিঃসংশয়।
রাজীববাবুর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে এগনো গেল টোটো স্ট্যান্ডের দিকে। টোটোচালকরা কী ভাবছেন? ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে খুব একটা খোঁজ খবর রাখেন না তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগর - এইরকম বিখ্যাত নাম ছাড়া আর কিছু মাথায় এল না তাঁদের। এখনকার লেখকদের নাম সেভাবে মনে করে উঠতে পারলেন না। সাহিত্যও খুব একটা পড়েন না। সময় কোথায়! পেটে তো দিতে হবে দুবেলা। কিন্তু বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন - “কেন থাকবে না! আমাদের বাপ ঠাকুরদা, মা, মাসি সবাই এই ভাষাতেই কথা বলে বড়ো হয়েছেন। আমরাও বড়ো হয়েছি। আমাদের ছেলেমেয়েরাও বলবে। বাংলা ছেড়ে কোথায় যাবে আর!” এক মুহূর্তে মনে হল, এঁরাও তো ভাষা-সৈনিক। ২১ ফেব্রুয়ারি না জেনেও বাংলাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। বাংলার পতাকা ওড়াচ্ছেন। নিজের মাতৃভাষাতেই পরিচয় যে আমাদের। এত সহজে কি মুছে ফেলা যায়…
আরও পড়ুন
মুছে আসা শালবন, মুছে আসা বাংলা, ফুলডুংরি পাহাড়— এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ
টোটো যেখানে নামিয়ে দিল, সেটা একটা বাজার, কলোনি বাজার। এইখানেই দেখা এক দিদির সঙ্গে। মহুয়া দত্ত অধিকারী। মেয়ে পড়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে। কেন দিলেন ইংরেজি মাধ্যমে? দিদির বক্তব্য, এখনকার হাই কম্পিটিশনের যুগে লেখাপড়া ভালো না করলে কোথাও চান্স পাওয়া যাবে না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার মান অনেক ভালো, তাই নিজের সন্তানকে সেখানেই দিয়েছেন। কিন্তু বাংলা ভাষা? ২১ ফেব্রুয়ারি? দিদির ছোট্ট উত্তর, “নো আইডিয়া ভাই।” বাংলা কি কোনভাবে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে এইভাবে? দিদির সেই ছোট্ট উত্তর, “নো আইডিয়া।”
এখনকার পড়াশোনার কেরিয়ারে ইঞ্জিনয়ারিং-কে বেছে নেয় বহু ছেলেমেয়ে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সেখানে তো সবই ইংরেজিতে। যারা বাংলা মাধ্যম থেকে এসেছেন, তাঁদের অসুবিধা হয় না? সেইরকমই একজন সুকন্যা সাহা। প্রথম প্রথম অসুবিধা হত, ভয় হত। কিন্তু পরের দিকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সুকন্যা। শুধু সে নয়, এমন কথা আরও অনেকেরই। তবে ওর কথাতেই উঠে এল অন্য একটা প্রসঙ্গ। “কম্পিউটার সায়েন্স বা অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয় বাংলাতে পড়ানোই যায়। কিন্তু কিছু কিছু শব্দ এমন আছে, যেগুলোর সহজ বাংলা করা যায় না। সেগুলো ইংরেজিতে বুঝলেই সুবিধা হয়। এটা বাদ দিয়ে বাংলায়, মানে নিজের মাতৃভাষায় পড়ার জন্য যে ভালবাসা দরকার, যে ধৈর্য দরকার, সেটা আমাদের অনেকের মধ্যেই আজ নেই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়, ইন্টারভিউ এবং অন্যান্য কম্পিটিটিভ ক্ষেত্রে ইংরেজিটাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই। সেখানে বাংলা ভাষা, এবং মাতৃভাষা অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে।”
গোটা দিনের শেষে এভাবেই নানা খণ্ডচিত্র উঠে এল আমাদের সামনে। এখান থেকে কোনো মতের ওপর পুরোপুরি সিলমোহর দেওয়াও যায় না। বাস্তব জীবনে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছেন না। যেহেতু এটা একটি প্রধান আন্তর্জাতিক ভাষা, তাই এটা শেখা জরুরি। কিন্তু তাই বলে মাতৃভাষাকে অবহেলা তো করা যায় না! বাংলাটা এমনি শিখলেই হয়ে যাবে, বা না শিখলেও বিশেষ ক্ষতি নেই - এই মনোভাব থেকে তো বেরিয়ে আসাটাই বাঞ্ছনীয়। শুধু ব্যবহারিক নয়, কাজের ভাষাও হোক বাংলা-সহ অন্যান্য মাতৃভাষাগুলো, এমনই দাবি হোক সবার। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম।” তাকেই দিনের শেষে অবহেলা করলে, নিজেকে চিনব কেমন করে! ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে তো সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া। শুধু ফেব্রুয়ারির এই একটি দিন নয়, প্রতিটা দিন হোক ভাষার উদযাপন। জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠুক মাতৃভাষা। বাংলাই হোক আমাদের মিলনের সেতু।