যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ— গণিতের এসব হাতিয়ারই তাঁর জানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও গাণিতিক সমস্যার শেষ ধাপে পৌঁছানো হয়ে ওঠে না কিছুতেই। কোথাও গিয়ে যেন খুঁজে পাওয়া যায় না গণিতের গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর পথ। বার বার স্কুলের পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া। বারবার সেই একই হতাশা। অন্যদিকে বছর চারেকের বড়ো নিজের দাদাই গণিতে রীতিমতো ‘রিমার্কেবল’ ছাত্র। ফলে সেই প্রসঙ্গে উঠে আসত শিক্ষকের বকুনিতে।
সেদিন ছোটোবেলায় গণিতে পায়ে পায়ে হোঁচট খাওয়া সেই কিশোরই আজ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। মুকুটে জুড়েছে শ্রেষ্ঠত্বের পালক— নোবেল পুরস্কার। স্যর রজার পেনরোজ। হ্যাঁ, এই বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর সারা শৈশব কেটেছে গণিতের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। পদার্থবিদ্যা বিভাগে নোবেল পুরস্কারের সম্মান জুটলেও, প্রফেসর রজার পেনরোজ প্রকৃতপক্ষে একজন গণিতজ্ঞ।
বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। বিশ্বজুড়ে বেজে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। আর সেই মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির অন্যতম অংশই হল ব্রিটেন। পরিণতি যে ভয়াবহ হতে চলেছে, খুব সহজে যে নিস্তার নেই এই যুদ্ধের তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কারোরই। যুদ্ধের আগুন থেকে পরিবারকে বাঁচাতে তাই বিদেশে পাড়ি দিলেন পেনরোজের বাবা। ১৯৩৯ সাল। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতি ঘনিয়ে এসেছে ততদিন। পেনরোজের নতুন ঠিকানা হল যুক্তরাষ্ট্র।
গণিতে অসুবিধা তো ছিলই। তার ওপরে নতুন শহরে এসে বদলে গেল সবকিছু। নতুন স্কুল, নতুন মুখ, নতুন শিক্ষক। লড়াইটা আরও কঠিন হতে চলেছে, তেমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। হল একেবারে উল্টোটা। এক তরুণ কানাডিয়ান শিক্ষকের চোখে আটকে গেলেন পেনরোজ। হয়তো দূরদর্শীই ছিলেন তিনি। তাই পরীক্ষার ফলাফল, ক্লাসের খারাপ পারফর্মেন্স দেখার পরেও বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে অপরিসীম বারুদ। ঘুমিয়ে পড়া সেই সত্তাটাকেই জাগিয়ে তোলার কর্মসূচি নিলেন সেই শিক্ষক। অসীম ধৈর্য নিয়েই হাতে ধরে শেখালেন অঙ্ককে। ভাবতে শেখালেন চক্রব্যূহ থেকে বেরনোর একটা নয়, থাকতে পারে একশোটা পথ।
সেই শিক্ষকের হাত ধরেই গণিতের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি হয়ে গিয়েছিল রজার পেনরোজের। জন্মেছিল জ্যামিতির প্রতি অফুরান আগ্রহ। তবে খুব বেশিদিন সাহচর্য পাওয়া হল না তাঁর। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই কাজের সূত্রে ব্রিটেনে সপরিবারে ফিরে এলেন পেনরোজের বাবা। ইউনিভার্সিটি কলেক লন্ডনে নিযুক্ত হলেন অধ্যক্ষ হিসাবে। সেই কলেজেই শিক্ষার্থী হিসাবে নাম লেখালেন পেনরোজ।
না, ফিরে তাকাতে হয়নি তারপর আর। স্নাতকোত্তর শেষ করে গবেষণার কাজ শুরু করলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই গণিতকে নিয়েই। গণিত বলা ভুল হবে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় টপোলজি। তবে পদার্থবিদ্যার প্রতিও একটা বাড়তি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন সেই শিক্ষক। গোপনে সেই ভালোবাসাকেও লালন করেছেন পেনরোজ।
আরও পড়ুন
ব্ল্যাকহোলের রহস্যে উঁকি দিয়ে পদার্থবিদ্যায় নোবেল তিন বিজ্ঞানীর
গবেষণা চলাকালীনই পেনরোজ নতুন করে ভাবলেন ‘অসীম’-এর সংজ্ঞা। ইনফিনিটি বলতে আমরা যা বুঝি, তা হল অনেক বড়ো কোনো সংখ্যা। যার শেষ নেই কোনো। তবে এক জায়গা থেকে পথ চলা শুরু করে বারবার যদি সেই বিন্দুতেই ফিরে আসা হয়। তাকেও কি ‘অসীম’ বলা যেতে পারে না? জ্যামিতির সাহায্যেই তৈরি করে ফেললেন বেশ কিছু নকশা।
একটা বর্গক্ষেত্রের চারপাশ দিয়ে উঠে গেছে দেওয়াল। আর তার গা বেয়ে উঠেছে সিঁড়ি। প্রতিটা সিঁড়ি বেয়েই উপরের দিকে ওঠা যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখা যাবে পরের দেয়ালের সিঁড়ি তার থেকেও উঁচু। যে গণিত একসময় গোলকধাঁধায় বেঁধে ফেলেছিল পেনরোসকে। সেই গণিত, সেই জ্যামিতির সাহায্যেই এমন গোলকধাঁধা তৈরি করে ফেললেন তিনি। একটা-দুটো নয়। এমন অসংখ্য ইলিউশনের জন্ম দিলেন পেনরোস।
ছেলেকে উৎসাহিত করতে বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না বাবারও। এক ডাচ শিল্পীকে দিয়েই সেইসব জ্যামিতিক ধাঁধার চিত্ররূপ দিলেন তাঁর বাবা। ১৯৬০ সালে পৃথিবী চাক্ষুষ করল এক অদ্ভুত ইলিউশন। আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় হামেশাই ঘুরে বেড়ায় সেসব ছবি। কখনো সেসব স্থিরচিত্র দেখেই মনে হয় দিব্যি ঘুরছে, অথবা চলমান তার জ্যামিতিক গঠন। অথচ কোথাওই উল্লেখিত হয় না তাঁর নাম। পেনরোস টাইলিং, পেনরোস ট্রাইবার কিংবা ইম্পসিবল স্টেয়ারকেসকে শুধুমাত্র ইলিউশন বলেই দিব্যি চালিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়া।
আরও পড়ুন
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কার করে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী
প্রফেসার পেনরোসের শেষ তুরুপের তাসও সেই ইলিউশনের ধারণার ওপরেই তৈরি। গবেষণার বিষয় ছিল ব্ল্যাকহোল। তবে এই ব্ল্যাকহোল আসলে কী? কেনই বা যাবতীয় শক্তি, পদার্থকে শোষণ করে নিতে পারে ব্ল্যাকহোল? উত্তর দিল পেনরোসের সেই ইলিউশনই। ‘অসীম’। ব্ল্যাকহোলের বাইরের পরিধিকে তিনি বর্ণনা করলেন ‘ট্র্যাপড সারফেস’ বা ‘বদ্ধ তল’ হিসাবেই। ফলে আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গও তার ভেতরে ঢুকে পড়লে আর বেরোতে পারে না। শেষ না হওয়া এক সিঁড়িই তার শেষ পরিণতি হয়ে যায়। আর এই ধারণার সঙ্গেই তিনি মিলিয়ে দিলেন নিজের তৈরি করা গাণিতিক সমাধানকে। তাতেই বাজিমাত। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এক নতুন রূপ পেল। এই ব্রহ্মাণ্ডের শেষও যে সেই ব্ল্যাকহোলেই সেই তথ্যও বেরিয়ে এল পেনরোজের সমীকরণ থেকে।
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী শেখর বসু, শেষ হল বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার একটি অধ্যায়
একজন অধ্যাপক হিসাবে চিরকালই তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন পেনরোজ। পাশাপাশি তাঁর নিজের এই চড়াই-উৎরাই জীবনও এক বাড়তি উদ্দীপনা তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে। নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর শুধু সকলের সামনে প্রকাশ্যে এসেছে তাঁর নামটুকু। তবে বহু আগেই অগোচরে বিস্ময় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি সাধারণ মানুষের থেকে। সকলের অজান্তেই। তাই বলা ভালো, ৮৯ বছর বয়সে নয়, বরং ১৯৬০ সালেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিলেন রজার পেনরোজ। শুধু ছদ্মবেশে মিশে ছিলেন মানুষের ভিড়ে...
তথ্যসূত্রঃ
১। রজার পেনরোজ (বায়োগ্রাফি) – ম্যাক টিউটর
২। Sir Roger Penrose: The man who proved black holes weren't 'impossible' – BBC
৩। উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor