লেননের শহর থেকে তিলোত্তমার লাল-হলুদ তাঁবু, রবি ফাওলারের হাতেই স্বপ্নের চাবিকাঠি?

উনিশ শতকের শেষের দিক। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা কলকাতা শহরে তখন ফুটবল খেলাটা আসছে সবে। বাংলার বুকে গড়ে উঠছে শোভাবাজার, মোহনবাগান, জোড়াবাগানের মতো ক্লাব। আর তখনই কলকাতা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরের এভার্টনের কর্তাদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব। অ্যানফিল্ড ফুটবল গ্রাউন্ডের স্বত্ব থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে মতানৈক্য। জন হৌলডিং-এর সঙ্গে বচসার পর এভার্টন চলে গেল পাশের মাঠ গুডিসন পার্কে। আর হোল্ডিং সাহেব খুললেন একটা নতুন ক্লাব – লিভারপুল। উত্তাল মহাসমুদ্রে বুকে বল যোগানো ‘লিভার’ বার্ড এই ক্লাবেও দ্যোতনা সৃষ্টি করবে, আশা ছিল এমনই। আর এই ঘটনার ঠিক ২৮ বছর পর কুচবিহার কাপে মোহনবাগান-জোড়াবাগান ম্যাচে শৈলেশ বোসকে খেলানো নিয়ে তুমুল বচসা। বাঙাল খেলোয়াড়দের অপমানের জবাবে জোড়াবাগান ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্লাব গড়ে ফেললেন নসা সেন, সুরেশ চৌধুরী আর শৈলেশ বোসেরা। বাঙালদের ক্লাব নাম হল - ইস্টবেঙ্গল!

তবে এই দুই ক্লাবের সঙ্গে রক্তাক্ত ইতিহাসের মিশে যেতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকটা বছর। ১৯০৬-তে অ্যাংলো-বোয়া যুদ্ধের সঙ্গে মিশে গেল অ্যানফিল্ডের ইতিহাস। জন লেননের শহরে হাজারে হাজারে মানুষ আঁকড়ে ধরলেন এই লাল জার্সিটা। সকলে আজও গ্যালারিতে গলা মেলান – ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন।’ তেমনি দেশভাগের পর উদ্বাস্তু ইতিহাসের দাগ, লড়াই লেগে গেল ইস্টবেঙ্গলের গায়ে। দুই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের ইতিহাসের কী আশ্চর্য সমাপতন!

আর আজ এই সন্ধিক্ষণে এ ইতিহাস আরও জীবন্ত হয়ে উঠল যখন অ্যানফিল্ডের 'গড', পুল সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে ওঠা রবি ফাওলার কোচ হয়ে এলেন পদ্মাপারের ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে।

রবি ফাওলার! নামটা ব্রিটিশ ফুটবলে একটা ঝড়ের মতোই এসেছিল নব্বই-এর দশকে। ছোট্ট রবি কিন্তু ছেলেবেলায় এভার্টন সমর্থক ছিলেন। কিংবদন্তি ইয়ান রাশের সান্নিধ্য পাওয়া, অ্যানফিল্ডে পাড়ি জমানো কিংবা সেখান থেকে একটু একটু করে কোপাইটস-দের মনের মানুষ হয়ে ওঠা - সবটাই দেখেছে নব্বই-এর দশক। প্রিমিয়ার লিগে তৃতীয় ম্যাচেই হ্যাট্রিক করা দিয়ে শুরু। সেখান থেকে টানা দশ মরশুম লাল জার্সিতে খেলে ফাওলার হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি, ইংল্যান্ডের মিডিয়া যাকে বলেছে- 'লিভারপুলের সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যাচেরাল গোলস্কোরার'। এরপর লিডস আর ম্যান সিটিতে ৫ মরশুম কাটিয়ে ফের একবার স্টিভেন জেরার্ডের সঙ্গে জুটি বেঁধে ফিরে এলেন লিভারপুলে। 

প্রিমিয়ার লিগে ৩৭৯ ম্যাচে ১৬৩ গোল,৩৯ টা আসিস্ট। ফুটবলার রবি ফাওলারের সামনে ধারে বা ভারে হয়ত এখনো কোচ রবি ফাওলার অনেকটাই ফ্যাকাশে। নিজের কোচিং জীবনে থাইল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় কিছু অভিজ্ঞতা নিয়েই ভারতে আসছেন ফাওলার। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তির পা পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের ফুটবল মক্কায়। এমন একটা সময়ে ফাওলার আসছেন, যখন লেসলি ক্লডিয়াসের ক্লাবের লাখ লাখ সমর্থক একটা ট্রফির আশায় দিন গুনছেন। ইস্টবেঙ্গলের বিগত বছরগুলিতে জাতীয় স্তরে সাফল্য নেই যা হয়ত তাদের সম্বৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে বেশ কিছুটা বেমানান। অন্যদিকে ৩০ বছর পর প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে লিভারপুল, ইস্টবেঙ্গলেও জাতীয় লিগের অপেক্ষা চলছে ১৭ বছর। এবার বাঙুর গোষ্ঠীর হাত ধরে দেশের শ্রেষ্ঠ লিগে এটিকে-মোহনবাগানের সঙ্গে পা রেখেছে তারাও। ফাওলারের সামনে কঠিন লড়াই। 

জন লেননের শহর থেকে তিলোত্তমার বুকে ফাওলারের নাম জড়িয়ে গেল লেননের জন্মদিনেই। তিনি কতখানি সফল হবেন তা সময়ই বলবে, কিন্তু ফাওলারের আগমনে যে ইস্টবেঙ্গল বিশ্বের দরবারে একটা আলোড়ন ফেলল তা বলার অবকাশ রাখে না। রয়টার্স, ই এস পি এন, লিভারপুল নিউজ থেকে ইংল্যান্ডের তাবড় মিডিয়ার পাতায় ফাওলারের সঙ্গে উঠে এল ইস্টবেঙ্গলের নামও। এবার দেখার, প্রত্যাশার পারদকে ড্রিবল করে সাফল্যের জালে বল ঠেলে দিতে পারেন কিনা লিভারপুলের এই কিংবদন্তি...

আরও পড়ুন
আইএসএল-এর একাদশ দল ইস্টবেঙ্গল, রবিবার সকালে মিলল চূড়ান্ত শিলমোহর

Powered by Froala Editor

Latest News See More