‘বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’

দুর্ধর্ষ দুশমন – ৮

আগের পর্বে

চম্বল বলতেই মানসিং, লাখন সিং, পান সিং তোমার, ফুলন দেবীর নাম ভেসে আসে। কিন্তু চম্বলে বাগী রাজত্বের শুরুয়াত তার বহু বহু আগে থেকে। রাজস্থানের বৎসগোত্রীয় মহাসেন ছিলেন চম্বলের প্রথম নথিভুক্ত বাগী। তিনি রাজা ভোজের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন বিদ্রোহ। পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজত্বকালেও ছিল বাগীদের উৎপাত। চম্বলের বাগীদের খপ্পরে প্রাণ গেছিল আকবরনামার রচয়িতা আবুল ফজলের। অল্পের জন্য বেঁচেছিলেন হিউয়েন সাং। মূলত পাঁচের দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ অবধি চম্বলের খ্যাতি তাঁদের জন্যই। যাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদে বাধ্য হয়েছিলেন হাতে অস্ত্র তুলতে।

এবার আমার গন্তব্য ভিণ্ড। মহাবীরের বাড়িতে সকালে উঠে চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। বাহ্‌ হয়ে ভিণ্ড যাব। ৬৫ কিমি রাস্তা বাসে, জ্যোত কালান থেকে। গতকাল মহাবীর বলেছিলেন, আমাকে বাইকে করে ছেড়ে দেবেন, আগের দিন যেখানে দেখা হয়েছিল সেখান পর্যন্ত। চা খাওয়ার পর সে কথা বলতেই বারবার এড়িয়ে যেতে থাকেন মহাবীর। ততক্ষণে কয়েকজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী এসে মহাবীরের খাটিয়ায় বসে আড্ডা দিতে শুরু করেছে। যতবারই মহাবীরকে বলি ততবারই সে আমাকে বলে, ‘আরে বড়ে রাস্তা মে চলা যাও, ওয়াহ সে জিপ মিল জায়েগি তুঝে’। বুঝলাম আমাকে একাই যেতে হবে। এক বৃদ্ধ বলে, যাবে কোথায়? বললাম, জ্যোত কালাঁ যাব, সেখান থেকে যাব ভিণ্ড। এইবার আমাকে অবাক করে রাস্তা খানিকটা সহজ করে দিলেন মহাবীর। বললেন, এখান থেকে মেন রাস্তায় গিয়ে জিপে করে নদ্গাঁও যাও, সেখান থেকে চম্বল নদীর খেয়া পার করে ছাত্তাপুর (ছতরপুর), সেখান থেকে জিপে ভিণ্ড। সব মিলিয়ে কুড়ি কিমি। অত ঘুরতে হবে না।

বেলা তখন সাড়ে আটটা। বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি। জিপের দেখা নেই। এক-দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে গেল। বড়ো রাস্তার মোড়েই একটা পুলিশফাঁড়ি গোছের রয়েছে। তার সামনে কয়েকজন পুলিশও দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে তারাও জ্যোত কালাঁর দিকে যাবে। আমি তখন আমার কথা বলি। তারা বলে, ‘দেখো জিপ কব আতে হ্যায়’। হঠাৎই খানিকটা সুরাহা হয়ে যায়। উল্টোদিকে খেতের ভেতর আলপথের রাস্তা ধরে একটা টোটোগোছের গাড়ি এগিয়ে আসছিল। তাকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করাল পুলিশগুলি। তারপর এক প্রকার জোর করেই তাতে চেপে বসল। আমি তাদের বললাম, যদি আমাকে একটু নদগাঁ অব্দি ছেড়ে দেওয়া যায়। প্রথমে না করলেও পরে যখন আমি তাদের জানালাম যে আমি একজন সাংবাদিক, আর আমি কলকাতা থেকে এসেছি, তখন কাজ হল। তারা আমাকে তুলে নিল গাড়িতে।

প্রায় ঘণ্টা দুই অপেক্ষার পর গাড়ি পেলাম। বুঝলাম এই এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থার কী হাল, বুঝলাম এই এলাকার মানুষের কাছে এখনো সে অর্থে আমরা যে প্রভূত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি শহরাঞ্চলে বসে, তার অনেককিছুই পৌঁছোয়নি। নদ্গাঁ পৌঁছে দিয়ে পুলিশেরা চলে গেল জ্যোত কালাঁর দিকে। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল এখানে দাঁড়িয়ে জিপের অপেক্ষা করতে। এখানেও সেই অন্তহীন জিপের অপেক্ষা। দাঁড়িয়েই রয়েছি। আশেপাশে গুমটির মতো চায়ের দোকান রয়েছে একটা। সেখানে বসে গ্রামের বৃদ্ধরা চা খাচ্ছে। আমিও এককাপ চা নিয়ে দাঁড়ালাম। ওই বয়স্ক মানুষদের প্রশ্ন করলাম জিপ কতক্ষণে আসে। নানান টুকটাক গল্প চলতে লাগল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করল কোথা থেকে আসছি ইত্যাদি ইত্যাদি। বললাম চম্বল নিয়ে জানতে এসেছি।

এই রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়ালেও গাড়ি পাওয়ার সম্ভবনা ক্বচিৎ

 

আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও

এবার তারা একটু নড়েচড়ে বসল। একজন নেতা গোছের বৃদ্ধ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপ পত্রকার হ্যায়? তো লিখিয়ে না হামারে বাড়ে মে’। জিজ্ঞাসা করি, কী লিখব? সে জানায়, লিখুন না আমাদের দুর্দশার কথা। আমি বললাম, কেন তোমাদের আবার কী হয়েছে? এই তো সুন্দর রাস্তাঘাট হয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে লেখা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী সড়কযোজনা। তার মানে সরকার তো তোমাদের জন্য কাজ করছে। শব্দ করে হাসলেন বৃদ্ধ। তারপর আমাকে বললেন, ‘আপ ভি ধোকা খা গয়ে না, বাহারকি চকাচৌন্ধ সে?’ গল্পের গন্ধ পেলাম।

কী ব্যাপার প্রশ্ন করায়  বয়স্ক বৃদ্ধ জানালেন, রাস্তা আছে, অথচ গাড়িঘোড়া নেই। খেত আছে ধান আছে, কিন্তু চাষিদের হাতে পয়সা নেই। রেশনকার্ড আছে, কিন্তু ওই ভোট দেওয়ার জন্য, রেশন দোকান এতটাই দূরে যে যেতে গেলে একদিনের কাজ নষ্ট। গ্রামে ছোটো ছোটো পাঠশালা আছে, কিন্তু তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে হবে অনেক দূরে। গ্রামে ভালো স্কুল, কলেজ নেই। গ্রামের পাঠশালায় পড়ে, ছেলেমেয়েদের কলেজ যেতে গেলে যেতে হবে চম্বল নদী পেরিয়ে ভিণ্ডের দিকে। অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ। এই এলাকার চাষের জমি কিনে নিচ্ছে বড়ো বড়ো কর্পোরেট সংস্থাগুলো। হচ্ছে ফার্ম হাউস, নামীদামী স্কুল।

আরও পড়ুন
মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী রুক্মিণীদেবী

এভাবেই বাইকে লিফট দিয়ে চম্বল নদী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল গ্রামের মানুষ

 

কিন্তু তা এই এলাকার মানুষজনের জন্য নয়। শহরের বড়লোকেদের জন্য। শেষে বললেন, ‘সাহাব জিনকে পাস জমিন হ্যায়, ও তো হ্যায়, পার হম জ্যায়সে, জিনকে পাস জমিন নেহি হ্যায়, দুসরেকে জমিন পে কাম করতে হ্যায়, উনকি জিন্দেগি তো নরক সে বত্তর হ্যায়’। বললাম চেষ্টা করব তোমাদের কথা লেখার। কিন্তু এখান থেকে ভিণ্ড যাব, চম্বল নদীর খেয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়ার জিপ আসবে কখন? বৃদ্ধ জানায় কখন আসবে ঠিক নেই। তারপর নিজেই হাত তুলে একজন বাইক আরোহীকে দাঁড় করালেন। তাকে বললেন, এঁকে একটু খেয়াঘাট অব্দি পৌঁছে দাও। চায়ের দাম দিতে গেলাম, নিলেন না। বাইকের পেছনে বসেই সফর শুরু হল চম্বলের খেয়াঘাটের দিকে। আবারো সেই দু-দিকে বেহড়, কোথাও পাকা রাস্তা, কোথাও বেহড়ের মাঝখান দিয়েই কাঁচ মাটির রাস্তা পেরিয়ে পাঁচ কিমি রাস্তা যাওয়ার পর বাইক এসে থামল চম্বলের খেয়াঘাটে।

আরও পড়ুন
পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন

অতীতের চর্মণ্বতী আজকের চম্বল। ৯৬০ কিমি লম্বা। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে ইন্দোরের কাছে মউ শহর থেকে উৎপত্তি হয়ে মধ্যপ্রদেশ রাজস্থানকে বেড় দিয়ে উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ায় গিয়ে মিশেছে, যমুনা নদীতে। এটাওয়ার কাছেই যমুনা, চম্বল আর তার শাখা নদী কুঁয়ারী, কালী সিন্ধ, পাহুজ মিলে পাঁচ নদীর সঙ্গম স্থল। স্থানীয় ভাষায় বলে পাঁচনদা। আর এই পাঁচ নদীকে কেন্দ্র করেই চম্বলঘাটি আর তার বেহড়ের বাগী সভ্যতা। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থানের বেশ কিছু জায়গা নিয়ে চম্বল-রেঞ্জ। উত্তরপ্রদেশের মহু, খেড়া রাঠোর, বাহ, জালৌন, এটাওয়া আগ্রা। এছাড়া এটাওয়া আর কানপুরের মাঝামাঝি ঠাকুরদের প্রভাবিত চৌরাশি গাঁও (চুরাশি গ্রাম), মাল্লাহ (মাঝি) জাতির  আধিপত্যের একশো-তেরোটা গ্রাম। যা ছিল ডাকাতদের আশ্রয়স্থল। মধ্যপ্রদেশের ভিণ্ড, মোরেনা, গোয়ালিয়র, দাতিয়া, অম্বা, জৌরা ওদিকে রাজস্থানের ধৌলপুর, ভরতপুর সব মিলিয়ে রয়েছে ভয়াবহ বেহড়। চম্বলের ডাকাতদের অভয়ারণ্য। এই ভয়াবহ বেহড়ে ঢুকে ডাকাত মোকাবিলায় পুলিশ, মিলিটরিরাও ভয় পায়। সেই ভয় এখনো বিদ্যমান। বেহড়ের ছোটোছোটো জঙ্গল ঘেরা অলিগলি পথ, কোনোমতে একজনের চলার উপযুক্ত। সেখান ডাকাত খোঁজা দূর অস্ত, একবার রাস্তা হারালে গোলকধাঁধায় ঘুরতে হবে বেশ কিছুদিন, যতক্ষণ না কেউ উদ্ধার করে আনছে।

চম্বল নদীর খেয়া ঘাট

 

আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়

যতদূর চোখ যায় দু-ধারে বিস্তীর্ণ বেহড় আর জঙ্গল। মাঝখানে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ চম্বল নদী। এতটাই স্বচ্ছ যে নীচে মাছেদের চলাচল পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জল প্রায় নাক অবধি কিন্তু স্রোত ভয়ঙ্কর। স্রোত এতটাই যে মাঝে মাঝে তো জলে নেমে মাঝিকে গুণ টেনে নৌকো নিয়ে যেতে হচ্ছে ওপারে। চম্বলের উপর দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্রিজ, শেষ কবে হবে, জানেন না স্থানীয়রাও। তিন বছর ধরে চলছে কাজ। এপারে বালির উপর চারটে বাঁশ পুঁতে শুধু ছাউনিটুকু দিয়ে টিকিটঘর। ওপারে যাওয়ার ভাড়া পনেরো টাকা। নৌকো করেই বাহ্‌, নদগাঁও, মউ, থেকে রোজ স্থানীয় মানুষ বাইকে করে এসে, বাইক নৌকোয় তুলে নদী পার করে কাজে যায় মধ্যপ্রদেশের ভিণ্ডে, আবার ফিরেও আসে একইভাবে। এভাবেই নৌকো করে পার হয় মানুষের সঙ্গে গরু-ছাগলও। একমাত্র যাদের উট আছে, তারা উটের পিঠে চড়েই পার হয় নদী। ওপারে পৌঁছে, অতিকষ্টে বালির উপর হেঁটে জিপস্ট্যান্ডে পৌঁছোনো গেল। স্ট্যান্ড নামেই। দুটো কী তিনটে জিপ। একটাতে বসতেই ছেড়ে দিল। সেই একই দৃশ্য এপারেও। বেহড়ের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা। কিছু খবরের আশায় আলাপ জমালাম জিপে বসা দেহাতী মানুষগুলোর সঙ্গে। পুরুষদের প্রত্যেকের পরনে ধুতি-কুর্তা, পায়ে চপ্পল নয়তো পাম্প-শু।

নদীর স্রোতে খেয়া বাইতে সমস্যা হলে এভাবেই গুন টেনে নৌকা চালানো হয়

 

আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে

জিজ্ঞাসা করলাম চম্বলের অবস্থা এখন কেমন? ডাকাতরা কি এখনো আছে? এদেরই একজন বয়স্ক যশবর্ধন সিং গুজ্জর বলে উঠলেন, ‘আব ওহ চম্বল না রহি বাবু। চম্বল আভি পেহেলে সে সুধার গয়া। পর ভরোসা কুনহ নেহি। ই সালি জমিনোই অ্যায়সান হ্যায়। বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’। ড্রাইভার রতন সিং বলে ওঠে, ‘সাহাব চম্বল কা তো একহি ধরম হ্যায় খুন কা বদলা খুন। ইহা আগর আপকে দুশমন জীবিত রহে জায়ে তো লোগ উসপর থুকতে হ্যায়’ বলেই বুন্দেলখণ্ডীতে গাইতে শুরু করে, ‘আঠারহ বরস লৌ ছত্রী জীবে/ বাকি তো ফির জীবে সিয়ার/ জাকী বৈরি জীবিত বৈঠা/ ওয়াকে জীবোন রহে ধিক্কার’।

Powered by Froala Editor

More From Author See More