দুর্ধর্ষ দুশমন - ৬
আগের পর্বে
চম্বলের প্রতিটি বাগির মৃত্যুর পিছনেই রয়েছে পুলিশের শঠতা। তাই তাঁদের নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার পিছনেও হাত রয়েছে পুলিশেরই। টি ক্যুইন ৯ ব্যাটেলিয়ন পুলিশ নিয়েই ঘিরে ফেলেছিলেন নাগরা, উদ্যোতগড়, মহুয়া আর কালি ওরলি। লাখনকে মারতে পারেনি পুলিশ। তবে ক্যুইনের চক্রান্তে পা দেন রূপা। রুপাকে ডেকে পাঠাতে গ্যাং ছেড়ে কেবলমাত্র এক সঙ্গীকে নিয়েই রূপা গিয়েছিলেন ক্যুইনের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর সেই শঠতার জেরেই ধরাশায়ী হলেন রূপা মহারাজ। যে রূপা মানসিংয়ের বড় ছেলের মত ছিলেন, তাঁর পরিবারের সঙ্গে এখন আর সেভাবে সম্পর্ক নেই মানসিংয়ের বংশধরদের। কারণ এখনও লুকিয়ে ডাকাতি চালায় রূপার পরিবার। পারিবারিক অনুষ্ঠানে এলেও গোপন রাখে সব কথাই। যাই হোক এনকাউন্টারের পর পুলিশের থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া জমি একাই উদ্ধার করেছিলেন মানসিংয়ের স্ত্রী রুক্মিণীদেবী। তাঁর ব্যক্তিত্ব অবাক করেছিল পুলিশ আর নেতানেত্রীদেরও।
‘অভিশপ্ত চম্বল’ যারাই পড়েছেন তারা খানিকটা চেনেন রুক্মিণী দেবীকে। মানসিং-এর স্ত্রী। পরবর্তীকালে যখন মানসিং পালিয়ে পালিয়ে বেহড়ে জীবন কাটাচ্ছিলেন সেই সময় যে ব্যক্তিত্ব, যে সাহস স্থিতধী মনোভাব রুক্মিণীদেবী দেখিয়েছিলেন তা তৎকালীন বড়ো বড়ো নেতামন্ত্রীদেরও চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল। মহাবীরের কাছ থেকে সেভাবে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু নরেশ সরাসরি রুক্মিণীদেবীর কাছে মানুষ। অগত্যা নরেশকেই খোঁচা দিই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান প্রশ্ন করতে থাকি। এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নবাণে জর্জরিত নরেশের কাছ থেকে উদ্ধার হয় অনেক কিছু।
দাদুর কথা আবছা মনে রয়েছে, কারণ, তার খুব ছেলেবেলাতেই এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিলেন মানসিং। তবে তিনি তার আম্মার (মানসিং-এর স্ত্রী) কথা ভালো জানেন। আসলে তাদের ভাইয়েরা সবাই এই আম্মার কাছেই মানুষ। দাদু এবং বাবা মারা যাওয়ার পরই রুক্মিণীদেবীই হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের মুখিয়া। যতদূর সম্ভব সকলকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কাজে লাগিয়েছেন। পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করেছেন নিজেদের জায়গা জমি। সেই রুক্মিণী, অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী আনপড়-গাওয়ার রুক্মিণীদেবী। যিনি লেখাপড়া না শিখেও, শুধুমাত্র ব্যক্তিত্বের জোরে তাবড় তাবড় পুলিশকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবং সেই সমস্ত পুলিশকর্তা এবং নেতা মন্ত্রীরা পরে স্বীকারও করেছেন রুক্মিণীর ব্যক্তিত্ব এবং স্পর্ধা দেখে তারাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এমন ব্যক্তিত্ব বোধহয় মানসিং-এর স্ত্রীকেই মানায়।
সেই রুক্মিণীদেবী যিনি নিজের ছেলের শোকে পাগল হয়ে স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন প্রতিশোধ নিতে। ‘অভিশপ্ত চম্বল’-এর কিছু ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করি নরেশকে। তোমার আম্মার কাছে তো তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. কৈলাসনাথ কাটজু এসেছিলেন মানসিং-এর আত্মসমপর্ণের প্রস্তাব নিয়ে। জানো সে ব্যাপারে কিছু? হা হা করে হেসে ওঠেন নরেশ। তারপর মন্দির চত্বরের আমগাছগুলির চূড়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সাহাব বচপনসে বহুত দেখা হামনে, আম্মাকে পাস বড়ে বড়ে নেতা আতে থে, মন্ত্রী আতে থে, হাতজোড় কর কহেতে থে, বাবাকো আত্মসমর্পণ করওয়াও। শালে সবকো ভাগা দেতিথি আম্মা। কৈলাসজি আয়ে থে, অউর উনকে সাথ আয়ে থে মধ্যপ্রদেশকে অউর এক মন্ত্রী, মনোহর সিং মেহেতা (তৎকালী মধ্যভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)। বোলে থে আম্মাকো, মানসিংকে সমঝাও হাতিয়ার ডালনেকে লিয়ে। আম্মা তব বোলে থে উনসে, ‘পুরা গাঁওকে এক ভি আদমিসে কেহেলওয়া দো কি মেরা শোহর খারাব আদমি হ্যায়। ম্যায় মান লুঙ্গি। অউর উনসে কহুঙ্গী হাতিয়ার ডালনেকে লিয়ে। যাও পেহেলে পুঁছো গাঁওয়ালে সে’। ভাগা দিয়ে শালো কো’।
আরও পড়ুন
পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন
সেই সময় কত বয়স ছিল নরেশের? তাঁর কথায় ‘মেরা উমর তব আট-ন-সাল থা, ইসিলিয়ে ইয়াদ হ্যায়, সাহাব’। ভাবা যায় সেই রুক্মিণী, যার ব্যক্তিত্বের সামনে দেশের রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নরেশ জানায় ‘আখির মে আম্মা টুট গয়ী থি, পুলিশ সে হামারা জমিন ছুড়াতে ছুড়াতে। ইয়া তক কি এক টাইম থা, যব গাঁওকে কোই ভি উনসে কিসি চিজকে লিয়ে প্যায়সা নেহি লেতি থি, মগর এক টাইম অ্যায়সা ভি আয়া থা, ঘরসে থানে জানেকে লিয়ে উনকে পাস কিরায়া নেহি হোতে থে। যো লোক উনসে এক টাইম পে ডরতে থে, আঁখে ঝুকাতে বাত করতে থে, ওহি লোগ এক টাইমপে আকে উনসে বততমিজি কি থি, উনকো গাড়ি সে উতর দিয়ে থে’। একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের পরিহাস, রাজা মানসিং-এর স্ত্রীকে সামান্য ভাড়ার জন্য গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়
আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে
নরেশ সিং হলেন, মানসিং-এর বড়োছেলে যশবন্তের সন্তান, ভরত সিং-এর একমাত্র ছেলে। নরেশ এই মন্দিরের দেখাশোনা করেন। তার দুই ছেলে, দুজনেই চাষের কাজ দেখেন। কথা বলতে বলতেই চা নিয়ে আসে নরেশের ছেলে গোবিন্দ সিং। নরেশ জানান পুলিশের বটোয়ারায় এই বাড়িটা আর মন্দির সংলগ্ন জমি তার অংশে পড়েছে। এখন প্রায় সাড়ে-ছটা বাজতে চলল। দেখতে দেখতে মন্দির চত্বরে দেহাতি মানুষদের ভিড় জড়ো হয়েছে। এবার মন্দিরের পুজোর সময়। তেহেশিলদার সিং-এর নিজের হাতে বানানো এই মন্দিরে শুরু হল পুজো। অন্যান্য দেবদেবীর পুজো শেষ করে সকলে এই মন্দিরের প্রধান দরজার সামনে রাখা প্রধান মূর্তির (মানসিং আর রুক্মিণীদেবীর মূর্তি) সামনে বসলেন। তারপর ঠেঁট বুন্দেলখণ্ডী ভাষায় সেই পুরোনো চারণ কবিদের মানসিংকে নিয়ে লেখা প্রচলিত গানের আসর বসল। সেই সঙ্গে ঢোল আর তাসা, রয়েছে হারমনিয়ামও। সেই গান শুনতে শুনতে কেবলই মনে পড়ছিল, একজন মানুষ, যাকে গোটা ভারত দুর্ধর্ষ ডাকাত হিসেবে জানে, তার কতটা ক্যারিশমা থাকলে, তার মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি বেঁচে থাকেন এই মানুষগুলোর মনে। কতটা তার প্রভাব যে এই একবিংশ শতাব্দীতেও তিনি পূজিত হন এই অজ পাড়াগাঁর ছোট্ট জনপদে। আর হবে নাই বা কেন? তিনি যে সকলের দাউ, সকলের ত্রাতা, রাজার রাজা, চম্বলের রবিন হুড মানসিং তোমর রাঠোর। অন্ধকার হয়ে এসেছে, মহাবীরকে ফেরার কথা বলি। সেই নামগানের ভেতরেই জমির আলপথ ধরে আমি আর মহাবীর হেঁটে আসি, আর পেছনে ঢোলের তালে ভেসে আসে চারণ গীতের সুর,
আরও পড়ুন
‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’ - শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপা ডাকাতের নাতি
‘রাস্তা চলতা কোই নেহি লুটা,
মিত্রৌঁ শুনলো কান লাগায়।
আপনা দুশমন জিয়ত না ছোড়া,
বায় গোলি সে দিয় উড়ায়।
জাইগ্রাম মে মানসিং পোঁহচে,
খাতির উসকি কর বনায়।
বারহ বরষ কো এক যুগ বিতৌ,
আব আগে কা শুনল হবাল’।।
আরও পড়ুন
‘খুন কা বদলা স্রেফ খুন’; মানসিং-হত্যার পর, শপথ নিলেন চম্বলের নয়া ডাকাত সর্দার
এইবার আসি সেই প্রথম পর্বের রাতের আতঙ্কের কথায়। রূপার কাহিনি বলার সময় যার কথা উল্লেখ করেছিলাম। রূপার সেই বংশধর যে তার পূর্বপুরুষদের যাবতীয় উসুল এবং নিয়মকে ধুলোয় মিশিয়ে নিছক সাধারণ ডাকাত হয়ে গিয়েছে। নরেশের বাড়ি থেকে ফিরে আমার পুরনো বেসক্যাম্পে আসি অর্থাৎ মহাবীরের বাড়িতে। উঠোনে বেলগাছ তলায় খাটিয়া পাতা তাতে বসে আছি রামের গ্লাস হাতে। আমার জন্য বিলিতি রাম আর মহাবীরের জন্য দেশী দারু। উঠোন জুড়ে কচি পাঁঠা কষার গন্ধে মাতোয়ারা। আমার আসার পরই নিজেদের খোঁয়াড় থেকে বাছাই করা কচি পাঁঠা কাটতে আদেশ দিয়েছিলেন মহাবীর। মেহমানের খাতিরদারির জন্য। রাত আটটাতে এখানে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে দিই। উঠোনে বেল গাছ তলায় খাটিয়ায় শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত অল্প আলোয় বই পড়ছিলাম। এখন কখন চোখ লেগে গিয়েছিল জানি না।
রাত তখন তিনটে কুড়ি। আচমকা একটা কান ফাটানো বাইকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারে ঠাহর পেলাম না আমি ঠিক কোথায় আছি। উঠে বসে, চোখ কচলে চারদিকের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে দেখতে দেখতে মনে পড়ল আজ বিকেলেই আমি এসে পৌঁছেছি এখানে। আগ্রা থেকে প্রায় আশি কিমি দূরে বাহ ডিস্ট্রিক্ট। সেখান থেকে আরো কুড়ি কিমি দূরের এক অজ গ্রাম খেড়া রাঠোর। সেই গ্রামেই প্রবাদপ্রতিম চম্বল দস্যু মানসিং-এর বাড়ির উঠোনে একটা খাটিয়ায় শুয়ে আছি। আচমকা বাইকের হেড লাইটের জোরালো আলো এসে পড়ল মুখের উপর। চালককে দেখতে পাচ্ছি না, তবে বুঝতে পারছি আরোহী দুজন। বুন্দেলখণ্ডী মেশানো হিন্দিতে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ভেসে এল আমার দিকে, ‘কা হুই বাবু, হামার বাইক কি শোর নিন্দিয়া তোড় দিলা কই?’ উঠোনের আরো একটা লাইট জ্বলে উঠেছে ততক্ষণে। বেরিয়ে এল মানসিং-এর নাতির ছোটোছেলে সোমেন্দর সিং। বাইক চালককে সে প্রশ্ন করল, ‘কা হৈল লাল্লন’? ‘আরে মোতিয়াকে ঘর জানা হ্যায়। বাইকে হিয়াই খড়ি কর দে?’
মাথা নেড়ে সোমেন্দার হ্যাঁ বলাতে বাইক দাঁড় করিয়ে উঠোনের উলটো দিকে চলে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’? এইবার দেখতে পাই রাতের আগন্তুকের মুখ। প্রশ্নকর্তা প্রায় ছ-ফুট লম্বা, দু-কান পর্যন্ত লম্বা গোঁফ, ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তাকিয়ে রয়েছি, জবাব দেবো কী? সোমেশ্বরই জানাল আমার পরিচয় ‘কলকাত্তাকা পত্রকার, বাবাকে বারেমে জাননে আয়ে হ্যায়’। আমার দিকে একটা রক্ত জল করা দৃষ্টি হেনে রাতের আতঙ্ক চলে গেল উঠোন পেরিয়ে (পরে জেনেছিলাম এই সেই মানসিং-এর বড়োছেলের মতো শাগরেদ রূপনারায়ণ সিং-এর নাতি লাল্লন সিং, পূরণ সিং-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যার কথা আমাকে বলেছিলেন মহাবীর)।
Powered by Froala Editor