দুর্ধর্ষ দুশমন - ৩৭
আগের পর্বে
চম্বলের মানুষের বাগী হওয়ার পিছনে দায়ী সেখানকার ভূ-প্রকৃতিই। নদীর দ্রুত বহমানতায় ভারতের সবথেকে ভূমিক্ষয়প্রবণ রাজ্যগুলির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ। অর্থাৎ, মধ্যভারত। অন্যদিকে চম্বলের ৮০ শতাংশ মানুষই কৃষিনির্ভর। তবে হাতে গোনা কিছু কৃষক ছাড়া কারোরই পাম্পের সুবিধা নেই। বাকিরা বর্ষার ওপরেই নির্ভরশীল। তার ওপরে আরেক প্রতিকূলতা চম্বলের উঁচুনিচু জমি। আর জমি সমান করার প্রভাব চম্বলের মানুষদের ঠেলে দেয় সামাজিক-আর্থিক অসাম্যের দিকেই। পিছিয়ে পড়া মানুষদের কখনও নিষিদ্ধ করা হয় এই জমিতে প্রবেশ করাও। আর সেই কারণেই বাড়তে থাকে অপরাধের সম্ভাবনা। তারপর...
আমার চম্বলের সম্পূর্ণ সফরে বেশ কিছু ভূমিহীন মানুষের সঙ্গে পরিচিতি হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার দরুণ তারা আমাকে জানিয়েছেন যে প্রথমে তারা নিজেদের গবাদি পশু চড়ানোর জন্য বেহড়ের উপর নির্ভর করতেন, যা এখন আর সহজে উপলব্ধ নয়। এটাও একটা কারণ যে গবাদি পশুর সংখ্যা অনেকটাই কম হয়ে গিয়েছে, তাছাড়া বর্ষা আধারিত কৃষি আর গবাদি পশুর মধ্যে জৈবিক সম্পর্কও নষ্ট হয়ে গেছে। বেশ কিছু ভূমিহীন আর সীমান্ত চাষির কাছে এর অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাছাকাছি শহরের দিকে পালিয়ে যাওয়া যেখানে দিনমজুর, বাড়ির কাজের লোক অথবা কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।
এই ব্যাপার নিয়ে যখন আমার চম্বলের নানান জায়গায় মহিলাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে, তখন বহু মহিলাই ঘরের ভেতরে হওয়া দূষণের কারণে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা নিয়েও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। এর প্রভাব বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের উপরও পড়ে। বেহড়ে জ্বালানির কাঠকুটো একত্রিত করা দিনকে দিন মুশকিল হওয়ার কারণে গত বেশ কিছু বছরে এই এলাকায় ঘাসপাতার ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে আর্থিকরূপে দুর্বল পরিবারগুলিতে। এই পরিবর্তন স্থানীয় অর্থ ব্যবস্থা তথা সমাজকে আরো বিভেদের দিকে নিয়ে গিয়েছে যে কারণে উৎপীড়ন এবং অপরাধের দীর্ঘ ইতিহাস সমন্বিত এই এলাকায় সামাজিক অসমানতা আর মতভেদ বেড়ে গিয়েছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বাসস্থান নষ্ট হওয়ার কারণে জংলি জন্তু জানোয়ার সাধারণত ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে, পাকা ফসল নষ্ট করে দেয়। অনেক চাষীই জংলি জন্তু জানোয়ার দ্বারা হওয়া এই লোকসানকে আটকাতে না পারার নিজেদের যন্ত্রণার কথাও আমাকে বলেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু চাষী অড়হড় (ডাল) চাষ করাই ছেড়ে দিয়েছে, যা উৎপাদন করতে বেশি সময় লাগে আর দীর্ঘদিন ধরে তার সুরক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো এই সমস্যার কারণে তারা জমি চাষ না করে খালি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। অত্যাধুনিক মেশিনারির লভ্যতা আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাস্তা উন্নত হওয়ার কারণে এই এলাকায় ভূমি সমতল করার কাজ আরো দ্রুত গতিতে হচ্ছে। ভূমি সমতল করার জন্য মেশিনারি ভাড়া দেওয়া আর্থিক শক্তিসম্পন্ন স্থানীয় লোকেদের কাছে ব্যবসা করার সুযোগ হিসেবে সামনে এসেছে। অতিরিক্ত জমি শিল্পায়নের জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রকৃতিই কি আধুনিক ‘ডাকাত’ হয়ে উঠছে চম্বলের?
কিন্তু এই এলাকার সংবেদনশীল ইকোলজির জন্য এর দীর্ঘকালীন প্রভাবের কারণে এই ধরনের পরিকল্পনাগুলিকে পরীক্ষা করাও দরকার। এই ধরণের এলাকায় যেখানে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয় রয়েছে, সেখানে শিল্প, গোশালা ইত্যাদির পরিকল্পনা করা উচিত হবে না। ভূ-আকৃতি সম্পর্কিত বিজ্ঞান অনুযায়ী এই এলাকা এখনো ভারসাম্যমান পরিস্থিতিতে নেই। এই এলাকা এখনো ভূগর্ভীয় ক্ষয়ের প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মাটি ক্ষয়ের পরিমাণ কম করার জন্য সংবেদনশীল ইকোলজি সম্পন্ন এই এলাকায় সংরক্ষণ এবং বিকাশের বৈজ্ঞানিক, সুব্যবস্থিত আর সংবেদনশীল পরিকল্পনা বানানোর প্রয়োজন রয়েছে। এই এলাকায় যে কোনো অন্য নির্মাণগত গতিবিধি মাটির অধিক লোকসানের কারণ হবে তথা নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি জমা হওয়ার সম্ভবনা তৈরি করে দেবে। যে কারণে নদীর পুরো ইকোলজি সিস্টেমে এর প্রভাব পড়বে। এতে নিঃসন্দেহে আগামি দিনে আরো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ভূমিকে সমতল করার স্বল্পকালীন লাভ থেকে বড়ো লোকসান হতে পারে, যা পরিবর্তন করা যাবে না। লোকসান হওয়ার পর তা নিয়ে চিন্তা করার আগে একে রোধ করা ভালো। বেহড়কে সমতল করায় বাস্তুসংস্থানগত প্রভাব যা শুধু এমন অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশকে নষ্টই করবে তা নয় বরং এতে সামাজিক সৌহার্দ্যের উপরও বিপরীত প্রভাব পড়বে, মতভেদ আরো বাড়বে। আর, এর ফলে গরিবদের ওপর পলায়নের সংকট আরো বেশি করে তৈরি যাবে। অন্তত সংবেদনশীল ইকোলজির প্রতি সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিকোণ রাখারও প্রয়োজন রয়েছে। চম্বল উপত্যকার প্রতি আর্থিক লাভের সঙ্কীর্ণ ভাবনা সঠিক হবে না। কারণ, পয়সা দিয়ে প্রকৃতির মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। গত আট বছরে চম্বলে বেহড় ৪৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এই বেহড়ের কারণেই এখনো পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের মুরেনা, শেয়োপুর আর ভিন্ড জেলার প্রায় ১০৪৩টি গ্রাম নিজের জায়গা থেকে হারিয়ে গিয়েছে। যেভাবে বেহড়ের বৃদ্ধি ঘটছে সেই হিসেবে অনুমান করা হচ্ছে যে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৫৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি বেহড়ে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে প্রায় দু-হাজার জনবসতিপূর্ণ গ্রামকে চম্বলের বেহড় গ্রাস করে নেবে, যাদের উৎখাতের সংকট সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের হাতে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন হিউয়েন সাঙ!
আরও পড়ুন
গরুর চামড়া-ধোয়া জল থেকেই উৎপত্তি চর্মণ্বতী নদীর
তৎকালীন সময়ে বেহড় ডাকাতের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে চম্বলের প্রধান সমস্যা বেহড়। একবার দেখে নেওয়া যাক চম্বল এবং তার শাখা-নদীর অববাহিকায় কতটা এলাকা বেহড়ে পরিণত হয়েছে। চম্বল নদীর ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৮০ হাজার হেক্টরে বেহড় বিস্তৃত। কুয়ারী (কুমারী) নদীর ৭৫ হাজার হেক্টর এলাকা বেহড় বিস্তৃত। আসন নদীর ২ হাজার ৩৬ হেক্টর এলাকায় বেহড় বিস্তৃত। শিপ্রা নদীর ১১০০ হেক্টর জমিতে বেহড় ছড়িয়ে রয়েছে। বেসলী নদীতে রয়েছে ১ হাজার হেক্টর বেহড়। কুনো নদীতে রয়েছে ৮ হাজার ৭২ হেক্টর বেহড়, পার্বতী নদীতে ৭০০ হেক্টর, সাঙ্ক নদীতে ২ হাজার ১২২ হেক্টর, সিন্ধ নদীতে ২ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে বিস্তৃত রয়েছে বেহড়। আর এই বেহড়ের কারণেই মুরেনা জেলা থেকে ৫২০টি, ভিন্ড থেকে ১৭৩টি এবং শেয়োপুর থেকে ৩৪৭টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রালয় বেহড়ের উন্নতির পরিকল্পনা করেছিল। এই পরিকল্পনার অন্তর্গত ২৭ বছরে খরচ হওয়ার কথা ছিল ১২২৪ কোটি টাকা। আর এই পরিকল্পনার কাজ সাত বছরের চারটি ধাপে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তিন রাজ্য মিলিয়ে ৫৫ হাজার হেক্টর চাষের জন্য নতুন জমির বিকশিত করার কথা ছিল, যার মধ্যে ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের বাগান, ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বনাঞ্চল বাড়ানো আর পশুপালনের জমি বিকাশের কথা ছিল। অন্যদিকে ২ লক্ষ ২০ হাজার উঁচু বেহড় জমিতে জল ধরে রাখা, জল নিকাশির জন্য নালা এবং শেষ হতে চলা চাষের জমিকে বাঁচানোর জন্য বেহড়ে বাঁধ বানানোর কথা ছিল। আর এই পরিকল্পনার জন্য খরচ লাগার কথা ছিল আনুমানিক ২৮৩.৬২ কোটি টাকা। মধ্যপ্রদেশ সরকার ১৯৭৭-৭৮ সালে বেহড়ের বিকাশ করার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছিল। এই পরিকল্পনার অন্তর্গত মধ্যপ্রদেশের ভিন্ড, মুরেনা, দাতিয়া, গোয়ালিয়র এবং ছতরপুর জেলায় জলগ্রহণ এলাকায় এক লাখ হেক্টর জমির উন্নতি সাধন ঘটিয়ে তাকে কৃষিযোগ্য করার কথা আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু তাও বাস্তবায়িত হয়নি। বেহড়ে এখন সে অর্থ আগের মতো আর ডাকাত নেই কিন্তু এই উঁচু উঁচু বেহড়ের বিস্তৃতি দিনদিন বেড়েই চলেছে। যা নিয়ে রাজ্য সরকারের পাশপাশি চিন্তিত কেন্দ্রীয় সরকারও। একমাত্র মধ্যপ্রদেশেই এখনো পর্যন্ত ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমি বেহড়ে পরিণত হয়েছে। একটা রিসার্চ অনুসারে এখনই এই বেহড়কে আটকানো না গেলে আগামি ২০৫০ সাল পর্যন্ত আরো দু-হাজার গ্রাম বেহড়ের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
Powered by Froala Editor