দুর্ধর্ষ দুশমন - ৩৩
আগের পর্বে
একের পর এক এনকাউন্টার। তারপরেও মালখানকে ধরতে সক্ষম হয়নি পুলিশ। বদলে চম্বলে তার দাপট এতটাই বেড়ে যায় যে শত্রুরাও গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয় ভয়ে। অন্যদিকে ফুলনদেবী এবং বিক্রম মাল্লাহ বাবু গুর্জরকে হত্যা করে বিশ্বাস অর্জন করে মালখানের। ফুলনকে দলে জায়গা না দিলেও অন্যভাবে সাহায্য করে মালখান। একের পর এক অভিযানে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ মালখানের মাথার দাম বাড়িয়ে দেয় ৪০ হাজারে। তবে দস্যুসম্রাট হয়ে উঠলেও তার মধ্যে নেভেনি প্রতিশোধের আগুন। আর্মড পুলিশের আওতাতেই কৈলাস পণ্ডিতকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় মালখান। তারপর...
সেদিন চম্বলে উৎসব পালন করেছিলেন মালখান। দস্যু জীবনে প্রায় চারশোর উপর মামলা দায়ের ছিল মালখানের নামে। তার মধ্যে হত্যার সংখ্যা ছিল ১৮৫টি। প্রতিশোধ পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার। এরপর আর বেশিদিন বেহড়ে থাকেননি তিনি। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং-এর সামনে আত্মসমর্পণ করেন মালখান। তার শর্ত ছিল যদি সরকার সেই মন্দিরের জমি মন্দিরকে ফিরিয়ে দেয় তবেই আত্মসমর্পণ করবেন তিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে লিখিত দিতে হবে। রাজীব গান্ধী লিখিত দেওয়ার পরই আত্মসমর্পণ করেন তিনি। এর মধ্যেই তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এবং সন্তানদের হারাতে হয়েছে তাকে। আত্মসমর্পণের পর ৬০ বছর বয়েসে আবার বিয়ে করেন মালখান।
এই মুহূর্তে তার দুই সন্তান। অন্যান্য আত্মসমর্পিত ডাকাতদের মতোই নিজের গ্রামে থাকেননি মালখানও। কোথায় আছেন তিনি, কে জানে! তার সঙ্গে আমার দেখা হবে কিনা জানি না। সেই মালখান যিনি চম্বলের শেষ প্রবাদপ্রতিম দস্যুসম্রাট, উসুলওয়ালা ডাকাত। নারীদের প্রতি যার সম্মান ছিল দেখার মতো। কোনোদিন নিজের দলের কোনো নারীকে ঢুকতে দেননি। একসময় যখন বিক্রম মাল্লাহের মৃত্যুর পর ফুলন দেবী একা একা বেহড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সেইসময় মালখানের ভাগ্নে, ডাকাত ঘনশ্যাম সিং মির্ধা ওরফে ঘনসার সুপারিশে ফুলন এসেছিলেন মালখানের কাছে। হাত জোর করে কিছু খাবার আর অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্নের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে ফুলনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ কোনো নারীকে তিনি দলে রাখবেন না। কিন্তু একেবারে নারীবর্জিত ছিল না মালখানের দল। মালখানের দলেও ছিলেন এক দস্যুরানি। তার নাম ছিল কমলাসুন্দরী। তবে অন্যান্যদের সঙ্গে তার তফাৎ হল তিনি মালখানের রক্ষিতা ছিলেন না। দলে তার নাম ছিল পুষ্পাবহেন। তিনি সর্দার মালখানের বোন। পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী কমলা সরাসরি ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করত না। সে ছোটোছোটো ছেলেমেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে আসত। দলের অপহরণ করা বাচ্চা আর অন্যান্যদের দেখাশোনা করত। মালখানের সেবা আর দলের রান্নাবান্না করত।
বিলাওয়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি হাইওয়ের কাছে। হঠাৎই পেছন থেকে ডাক শুনতে পাই, ‘ভাইসাহাব, ও ভাইসাহাব থোড়া শুনিয়ে না’। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বছর পঁয়তাল্লিশের এর একজন আমাকে ডাকছেন। কী ব্যাপার? ‘আপ পত্রকার হো? দদ্দাকো ঢুন্ড রহে হো?’ অবাক হয়ে দেখি তার দিকে। তারপর জবাব দিই, কেন বলো তো? চরণ সিং কুশওয়াহ নামে সেই ব্যক্তিটি বলেন তাঁর সঙ্গে মালখানের যোগাযোগ রয়েছে। মালখান এখন থাকেন গোয়ালিয়রে। গত পরশু রাতেই মালখানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে এক বিয়েবাড়িতে। মালখান এখন সম্মানিত মানুষ। অতিথির বাড়িতে গেলে সেই নিমন্ত্রণ কর্তার মান বেড়ে যায়। নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে আমাকে বলেন, আজ তিনি গোয়ালিয়র যাচ্ছেন। মালখানের ঠিকানা আমার জন্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন তিনি। আমি যেন ওকে পরে ফোন করে নিই। বললাম, এ কথা তো আপনি গ্রামেই বলতে পারতেন আমাকে। তিনি জবাব দিলেন আমি জাতপাত মানি না। কিন্তু আমাকে পরিবার নিয়ে গ্রামে থাকতে হবে। ওখানে তোমাকে সাহায্য করলে আমি একঘরে হয়ে যেতাম। তাই এতদূর ছুটে এসেছি তোমার পেছনে। তুমি এই গ্রামটা নিয়ে লেখ। এখানে কোনো উন্নতি হয়নি। একটা জিনিস দেখবে এসো। বলেই আমাকে নিয়ে পাশের একটা বেহড়ে উঠলেন। তারপর আঙুল দিয়ে দেখালেন দূরের দিকে। দেখলাম, দূরে একটা ক্রেন আর নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে মাটি কেটে বেহড় সমতল হচ্ছে। বললাম বাহ, ভালো তো, তোমাদের চাষের জমি বাড়বে। আমাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটি বললেন, ‘আপ ভি ধোকা খা গয়ে না পত্রকারবাবু! ইয়ে জমিন হামারে লিয়ে নেহি। হিয়াঁ রাজনেতা, বড়ে বড়ে আদমি এক এক বীহড়কো দখল কর রহে হ্যায়, ভির উসে কাটকে হিয়াঁ পর ফার্মহাউস বনেগা। রাতমে পার্টি হোগা, জেনানি নাচ হোগা, দারুকে ফব্বারে ছুটেঙ্গে’। আঙুল দিয়ে অন্যদিকে একটা ফার্মহাউস দেখিয়ে বলেন, ‘ওহ দেখো’। প্রশ্ন করি, আপনারা বিরোধ করছেন না কেন? চরণজী আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে বলেন, সাহেব আমরা সামান্য মানুষ। আমাদের কী ক্ষমতা পলিটিসিয়ানদের বিরোধ করব। অবাক হই। এই গ্রামে জল নেই, এই গ্রামে একটা স্কুল পর্যন্ত নেই। মানুষের বেঁচে থাকার সামান্য সাধনের অভাব রয়েছে এখানে। অথচ নির্মল গ্রাম, প্রধানমন্ত্রীর নানা যোজনা, উন্নত ভারত কত কিছু প্রতিশ্রুতি। সবই উপর উপর। ভেতরে আসলে নিকষ অন্ধকার। হাইওয়েতে পৌঁছোনো মাত্র বাস পেয়ে গেছিলাম। উঠে বসি তাতে। আবারো ভিণ্ড শহরের দিকে আমার যাত্রা শুরু হয়।
আরও পড়ুন
শত্রুর মেয়েকে অপহরণ দলের, পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলেন ‘দস্যুসম্রাট’ মালখান
বাসে আসতে আসতেই ভাবছি, চম্বলে এত গল্প শুনলাম, এত রূপ দেখলাম, এত অভিজ্ঞতা। যেন আমি পর্দায় কোনো সিনেমা দেখছি। সকলেই একদম সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে আমার কাছে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সেই আগ্রা থেকে শুরু হয়েছে। জ্যোত কালানে নেমে মহাবীরের দেখা পাওয়া, জিপে যশবর্ধনের দেখা পাওয়া, ভিণ্ড রবিজী আর জগরূপজীর সঙ্গে দেখা। আবার এখানে এই রাজীব সিং কুশওয়াহ। যেন সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। এত সমাপতন কীভাবে সম্ভব। কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। তবে চম্বলে যা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তা হল এখানকার মানুষের সহনশীলতা। এই যে এত অত্যাচার, না পাওয়া, অন্যায় অবিচার সবই মুখ বুঝে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনে নিয়েছেন সকলেই। রা নেই কারো মুখে। আজ যখন চম্বল প্রায় ডাকাতশূন্য, তখনো এই যে বেহড় দখল হয়ে যাচ্ছে, এই যে গ্রামে নেই ইলেকট্রিসিটি, এমনকি নেই স্কুল পর্যন্ত। জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূর্ণ হয় না তাদের। তাও মুখে বুঝে মেনে নিয়েছে মানুষগুলো।
আরও পড়ুন
জগন্নাথ-খুনের বদলা নিয়ে তবেই হোলি খেলবেন, প্রতিজ্ঞা মালখান সিং-এর
এমন নয় যে সরকার এসব কথা জানে না। কারণ বাগী সমস্যার জন্য এই জায়গায় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল একসময় যে, সরাসরি কেন্দ্র থেকে নজর রাখা হত গোটা চম্বলের উপর। এমনকি এখনো রাখা হয়। এতটা অন্ধকার ভারতের আর কোথাও আছে কিনা জানি না। জাতপাত, ধর্মের বিভেদ, অপরাধ তো সারা ভারতেই রয়েছে, কিন্তু এত অনুন্নয়ন বোধহয় ভারতের আর কোথাও দেখিনি। দিল্লিতেও বস্তি দেখেছি, ঝুপড়ি দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গেও দেখেছি, কিন্তু এই পর্যায়ে নেই সেখানে। এখানের উন্নয়ন শুধু শহরাঞ্চলে, গ্রামে উন্নয়ন বলতে সিমেন্টের রাস্তা। অন্তত চম্বল যাত্রায় আমি দেখেছি, চম্বল ফুঁসছে। চম্বলে হয়তো এখন ডাকাত রয়েছে, বাগী সে অর্থে নেই। কিন্তু যেভাবে চম্বলকে ফুঁসতে দেখেছি তাতে এই অভিশপ্ত চম্বল যেকোনো দিন আবারো জেগে উঠতে পারে। চম্বল হয়তো ঠান্ডা হয়েছে, কিন্তু তার ধর্ম বদলায়নি।
আরও পড়ুন
‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’, এখনও বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা এই পরিচয়
মোহর সিং-এর একটা কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল। তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার শেষদিকে বেটা সম্বোধন করে মোহর বলেছিলেন, আমরা তো অস্ত্র ফেলে দিয়েছিলাম পুনর্বাসনের লোভে। কেউ কেউ পুনর্বাসন পেয়েওছে। কিন্তু অধিকাংশই পায়নি। এখনো তার পুরোনো সঙ্গীদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, অনেককেই মোহর বলতে শুনেছেন যে তারা হাতিয়ার তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে। আবারো যদি পুরনো আতঙ্কের পর্যায়ে ফিরে যায় চম্বল, তাহলে এখানকার মানুষকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না। মোহর সিং সরকারের কাছ থেকে দেড়শো বিঘা জমি পেয়েছেন কিন্তু তার অধিকাংশ সঙ্গীই পাননি। যেমন পুনর্বাসনের পর কিছুই পাননি মাধো সিং। শেষ বয়সে ছেঁড়াফাটা জামাকাপড় পরে রাস্তায় রাস্তায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে রাস্তায় কলের জল খেয়ে থেকেছেন। সরকার শুধু তাদের আত্মসমর্পণ করিয়ে খবরের কাগজের শিরোনামে এসে নিজেদের দায়মুক্ত হয়েছে। বিনোবা ভাবের সামনে আত্মসমর্পণের সময়, জয়প্রকাশ নারায়ণের সামনে আত্মসমর্পণের সময়, ঘটনা একই ঘটেছে। ১৯৬০, ১৯৭২, ১৯৮৩... তারপরেও যতবার চম্বলে আত্মসমর্পণ হয়েছে, রাজনৈতিক নেতারা পৌঁছেছেন কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য, কিন্তু ডাকাতদের পুনর্বাসনের কাজে এগিয়ে আসেননি কেউই। তাদের কাজ ছিল ডাকাতদের আত্মসমর্পণ করানো, কিন্তু তাদের ফের চম্বলে ফিরে যাওয়া আটকাতে সে অর্থে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। চম্বলের একটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী আত্মসমর্পণে যত ডাকাত ধরা দিয়েছিল তাদের মধ্যে ত্রিশ শতাংশ বাগী আবারো চম্বলে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন অভাবের তাড়নায়। কে নেবে এর দায়? কেউ না, নেয়ওনি কেউ।
Powered by Froala Editor