দুর্ধর্ষ দুশমন– ৩২
আগের পর্বে
বাড়ি থেকে মালখান তুলে এনে মারধর করে পুলিশ। পায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে কৈলাসের। ১৯৭০ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার পর কৈলাসের মূল চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে মালখান। অন্যদিকে খুন হন মালখানের গুরু জগন্নাথ। মালখান প্রতিজ্ঞায় ফিরে আসে চম্বলের আইন খুনের বদলা খুন। বেহড়ের পথ বেছে নেয় মালখান। বছর খানেক পর কৈলাসকে স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় সে। তারপর বেহড়ে বাড়তে থাকে তার দল। একের পর এক অপহরণের মাধ্যমে মোটা অর্থ উসুল করে মালখান। পুলিশের খাতায় তার নাম উঠে আসে ৪৯ থেকে ৩ নম্বর। তারপর...
মালখান নিজের রং দেখাতে শুরু করেন। চম্বলের দস্যুসম্রাট হিসেবে পরিচিতির জন্য তিনি পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি এনকাউন্ট করতে পেছপা হননি। চম্বলের লালপুরা বেহড়ে পুলিশের সঙ্গে তার বড়ো এনকাউন্টার হয়। প্রায় আঠেরো ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে সোজাসুজি গুলিবৃষ্টি করেও তার গ্যাং পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পুলিশ বুঝে গিয়েছিল যে চম্বলে আরো এক বাগী-দৈত্য এখন বোতল থেকে বেরিয়ে এসেছে। মালখানকে ধরতে মরিয়া মধ্যপ্রদেশ পুলিশ উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে প্রথম যৌথ অভিযান শুরু করে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মালখান এই অভিযানের মধ্যেও অপহরণ করা থামাননি। মাত্র এক মাসের মধ্যেই সিলুয়া ঘাটে আরো একটি বড়ো অপহরণ করে মালখানের দল সোজা পুলিশকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এবার পুলিশ তাদের অভিযান আরো জোরদার করে তাকে চম্বলে ঘিরে ফেলে। কিন্তু মালখান নিজের চতুরতা দেখিয়ে দল নিয়ে ঝাঁসি জেলার সমথর এলাকার জঙ্গলে পালিয়ে যান।
পুলিশের কাছে একমাত্র লক্ষ্য এখন মালখান, কিন্তু মালখান চম্বলে বুক বাজিয়ে খোলাখুলি নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। তার আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তার প্রবল প্রতিপক্ষ শত্রুও এবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে দেয়। কৈলাস পণ্ডিতের পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে পুলিশ প্রোটেকশনে দিন কাটাতে শুরু করে। চম্বলে সেই সময় মালখানের আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে অন্যান্য দলগুলিও মালখানকে ভয় পেতে শুরু করে। মালখান যাতে তাদের উপর কোনোমতেই ক্ষুব্ধ না হন, সেদিকে নজর দিতে শুরু করে তারা। মালখান বেইমান বাবু গুজ্জরকে ভোলেননি। একদিন চম্বলে তিনি বাবুর গ্রামে হানা দেন। বাবুকে না পেলেও তার বাবা, কাকা আর কাকার এক ছেলেকে গুলি করে খুন করে আরেক ভাইকে অপহরণ করে নিজের সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। চম্বলে সেইসময় দস্যু সুন্দরী ফুলনদেবী আর বিক্রম মাল্লাহ মালখানের বিশ্বাস হাসিল করে তার দলে শামিল হওয়ার জন্য বাবু গুর্জরকে খুন করে, আর মালখানের সেই পছন্দের উইনচেষ্টার রাইফেল তাকে উপহার হিসেবে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু ফুলনকে দলে জায়গা দেননি মালখান। যদিও অন্যরকমভাবে তাকে সাহায্য করেছিলেন মালখান। এদিকে মালখানের কার্যকলাপ খবরের কাগজের শিরোনামে চলে আসায় পুলিশও চাপে পড়ে যায়। আবারো মালখানের দলকে শেষ করার জন্য যৌথ অভিযান শুরু করে উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ পুলিশ। মালখানও চালাকি দেখিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান রাজস্থানে। সেখানে পৌঁছেই শুরু করে দেন অপহরণ। এবার রাজস্থানের ভরতপুরে মালখানকে ঘিরে ধরে পুলিশ। কিন্তু তার নামও মালখান সিং। পুলিশকে চমকে দিয়ে আবারো দল নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। তার আতঙ্ক যত বাড়তে শুরু করে ততই চাপ বাড়তে শুরু করে পুলিশের উপর। এরমধ্যেই আবারো ভাঙন ধরে মালখানের দলে। কয়েকজন মালখানের দল ছেড়ে চলে যায় নতুন দলে। কিন্তু এসবের পরোয়া না করে মালখান চম্বলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় চালু রাখেন। অচিরেই চম্বলে মালখান সম্রাটের মতো ব্যবহার পেতে শুরু করেন। যে-ই মালখানের বিরোধিতা করে তাকেই নিকেশ করে দেন তিনি। এরমধ্যেই বাহ জেলায় তিন ডাকাতকে চিরনিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে দেন দদ্দা মালখান। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে চম্বলের প্রতিটা রাস্তায় যেন মালখানের দৃষ্টি রয়েছে। মাত্র মাস পাঁচেকের মধ্যে এত কাণ্ড ঘটান মালখান যে পুলিশ প্রায় ছন্নাছাড়া হয়ে পড়ে। একটা তালিকা দিলেই বোঝা যাবে।
আরও পড়ুন
জগন্নাথ-খুনের বদলা নিয়ে তবেই হোলি খেলবেন, প্রতিজ্ঞা মালখান সিং-এর
আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের গোলোকধাঁধায় প্রাণসংকট, প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে প্রত্যেকটা ডাক
আরও পড়ুন
থিকথিক করছে পোকা, দূষিত জলেই তেষ্টা মেটান চম্বলের ‘নিচু জাতে’র মানুষরা!
১. ৩০ অক্টোবর— ওসাই থেকে ৪ জন কিডন্যাপিং
২. ২২ ডিসেম্বর— তিনজনকে খুন
৩. ২৬ ডিসেম্বর— এক কৃষককে গাড়িয়া থেকে অপহরণ
৪. ১১ মার্চ— বিনাতকিপুরা থেকে ৭ জনকে অপহরণ
৫. ২৭ মার্চ— অস্থপুরা থেকে ৫ জনকে অপহরণ
৬. ৩ মে— নওয়াদা থেকে ৪ জনকে অপহরণ
৭. ১ জুন— তেহানগুড় থেকে ৯ জনকে অপহরণ
পুলিশের কাছে মালখান ধাঁধার মতো হয়ে উঠেছিলেন। পুলিশ আবারো মালখানের মাথার দাম বাড়িয়ে ৪০,০০০ টাকা করে দেয়। পুলিশ একবার পরিকল্পনামাফিক মালখানের দলকে ধরার জন্য চক্রানগরে ঘিরে ফেলে, কিন্তু মালখান তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের চলে যান। পুলিশের কাছে মালখান যেন এক জিন হয়ে উঠেছিলেন, যে যখন তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত মালখানের দলকে শেষ করার জন্য তিন রাজ্যের পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে এক যৌথ কম্যান্ড তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে মালখানের বিরুদ্ধে পুলিশের কোনো পরিকল্পনাই কাজে দেয়নি। তার বিরুদ্ধে পুলিশের যে কোনো পদক্ষেপের জবাব হয় কোনো বড়ো অপহরণ নয়তো কাউকে খুন করে দিতে থাকেন মালখান। চম্বলে ধূর্ত বাঘ বলে ডাকা হতে শুরু করে মালখানকে। অন্যদিকে দস্যুসম্রাট হিসেবে পরিচিত হওয়ার শখ থাকা মালখানের হৃদয়ে কিন্তু এখনো প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল, আর তিনি যে-কোনো মূল্যেই সেই প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। চম্বলে নিজের রাজত্ব তৈরি করে ফেলা মালখান কিন্তু কৈলাস পণ্ডিতকে ভোলেননি। কৈলাসের খোঁজে চম্বল তোলপাড় করে চলেছিলেন তিনি। কিন্তু কৈলাসকে পুলিশ জালৌন জেলায় এক অভেদ্য সুরক্ষার মধ্যে রেখেছিল। কৈলাসের প্রতি বদলা নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকেন তিনি। চম্বলে মালখানের ছবি এক অন্যরকমের দস্যু সর্দারের। চম্বলে নীতিসম্বলিত ডাকাতদের পরম্পরার শেষ দস্যুসম্রাট হিসেবে পরিচিত পাওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সেই সময়ের চম্বলের বাগীদের নীতি ছিল প্রবল। যে কাজ তারা অন্যায্য বলে মনে করতেন, কোনোমতেই সে কাজ করতেন না তাঁরা। মালখান কতটা নীতিবান ছিলেন তা একটা ঘটনা থেকেই বোঝা যাবে। বেহড়ের এক প্রচলিত মিথ অনুযায়ী বলা হয় যে, একবার কৈলাস পণ্ডিতের মেয়েকে গ্রামে আসার পথে মালখানের দলের সদস্যরা অপহরণ করে। জানতে পারার পর মালখান পুরো দলকে তিরস্কার করেন আর সেই মেয়েটির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে, মেয়েটিকে প্রচুর উপহার দিয়ে তাকে স্বয়ং সঙ্গে করে গ্রামে ছেড়ে আসেন তিনি। ভাবা যায়? মালখান নিজের দলকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, কোনো মহিলার সঙ্গে যেন অসভ্যতা না করা হয়, আর যদি দলের কোনো সদস্য এই ধরণের কাজ করে তাহলে তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যু। এই নীতির জন্যই চম্বলের গ্রামে গ্রামে হিরোর মর্যদা পেয়েছিলেন তিনি। মানসিং যেমন পরিচিত ছিলেন ‘দাউ’ হিসেবে, মালখানকেও গ্রামবাসীরা ভালোবেসে ডাকতে শুরু করেন ‘দদ্দা’ নামে। কৈলাসকে মেরে ফেলার সংকল্প নিয়ে বেহড়ে ঝাঁপ দেওয়া মালখান এর মধ্যেই একদিন সেই খবর পান, যা শোনার জন্য তিনি এতদিন ধরে পাগলের মতো প্রতীক্ষা করছিলেন। মালখানের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কাশীরাম লোহার জালৌনে স্পেশাল আর্মড পুলিশের পাহারায় লুকিয়ে থাকা কৈলাস পণ্ডিতকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে শেষ করে দেয়।
Powered by Froala Editor